ব্রেস্ট ক্যান্সার কি ভালো হয়? বিস্তারিত জানতে Opal's Lens

ভূমিকাঃ ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার (Breast Cancer) বর্তমানে বিশ্বজুড়ে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্ণয়কৃত ক্যান্সার এবং ক্যান্সারে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। এটি কেবল উন্নত বিশ্বেই নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও, বিশেষ করে বাংলাদেশে, একটি ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী এই মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার ফলস্বরূপ বহু জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ২.৩ মিলিয়নেরও বেশি নারী নতুন করে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে প্রায় ৬,৮৫,০০০ মানুষ প্রাণ হারান। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক; সঠিক জাতীয় পরিসংখ্যানের অভাব থাকলেও, বিভিন্ন গবেষণা ও হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ এরও বেশি নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাব, দেরিতে রোগ নির্ণয় এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রাপ্যতা, যা আমাদের দেশের ব্রেস্ট ক্যান্সারের উচ্চ মৃত্যুহারের অন্যতম কারণ। এই আলোচনায় আমরা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ, লক্ষণ, নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যা আপনাকে এই রোগ সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা দেবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতায় গোলাপী ফিতা।
ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা রিবনঃ প্রাথমিক লক্ষণ চিনতে শুরু করুন! | Opal's Lens


ক্যান্সারঃ আত্মোপলব্ধি, অভিজ্ঞতাশিক্ষা


বিস্তারিত বা গভীর আলোচনায় যাওয়ার আগে, চলুন আগে স্তন ক্যান্সার নিয়ে একটি বাস্তব সত্য ঘটনা শুনে আসিঃ

ক্যান্সার। শব্দটাই যেন মৃত্যুর প্রতিশব্দ। কিন্তু এই যুদ্ধে শুধু রোগী নন, লড়াই করে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, আশা আর বাস্তবতার কঠিন টানাপোড়েন। আজ আমি আপনাদের শোনাবো আমার খুব কাছের এক আত্মীয়ার গল্প—স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের করুণ, শিক্ষাময়, আর মর্মান্তিক এক বাস্তবিক গল্প।


🎗গল্পের শুরুঃ

২০১৯ সালের আগস্ট মাসের কুরবানি ঈদের পর আমার কোন এক খুব নিকট আত্মীয়া আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসে, আমারই পরিবারের কোন এক সদস্যকে এসে জানায় উনার ডান স্তনের সাইডে বগলের কাছাকাছি একটা গোটা বা পিন্ডের মতো কিছু একটা সাদৃশ্য হয়েছে! কিন্তু সেটা ব্যথাহীন। তিনি এটা ঈদের অল্প কিছুদিন আগে দেখতে পান এবং উনি এসে প্রথমেই আমার বাসার সদস্যের সাথে শেয়ার করাতে, তিনি (আমাদের বাসার সদস্যা) বলেন খুব দ্রুত ঈদের ছুটি শেষে যেনো ডাক্তারের পরামর্শ বা সাহায্য নেয়। আর তিনিও ব্যাপারটা অতি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে, বেড়ানো শেষে উনার এলাকার হাসপাতালের ডাক্তার দেখান। ডাক্তার বিভিন্ন সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর মোটামুটি নিশ্চিত হোন যে, এটা সাধারণ কোন সিস্ট/ টিউমার না এবং কিছু পরীক্ষার ফলাফল খুব খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে! তারপর বায়োপসি রিপোর্ট আসার পর সেই সিস্ট/ টিউমারে ক্যান্সার স্টেজ-৩ ক্যান্সার আশংকা করা হয়।


🎗জীবনের নতুন ও ভিন্ন এক অধ্যায়ঃ

সাথে সাথেই সেখান থেকে ঢাকার টোলারবাগে অবস্থিত ডেলটা হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করা হয়, আমারই কোন এক পরিচিত ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে। সেই বন্ধুর পরামর্শে, একজন Oncologist Surgeon Prof. Dr. Tapesh Kumar Paul - কে দেখাই এবং পরবর্তীতে অপারেশন করে একটা স্তন ফেলে দিতে হয়। যদিও রোগী এবং তার পরিবারের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে, ডাক্তারের ইচ্ছে ছিল রেখে দেওয়ার। কিন্তু অপারেশন চলাকালীন অবস্থায় ঐ Lump এর জায়গায় আরও ২টা, মানে মোট ৩টা Lump পাওয়া যায়! তাই আর স্তন রাখা সম্ভব হয় নি। পরবর্তীতে সেই হাসপাতালেই অনকোলজিস্ট সার্জারি আর মেডিসিন বিভাগের ডাক্তারদের তত্বাবধানেই চিকিৎসা চলছিলো এবং সবকিছুই একটা কঠিন পরিস্থিতি ও বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিলো। কারণ এখানে দুইটা জিনিস কাজ করে, টাকা আর জীবন!


চিকিৎসা ও বাস্তবতাঃ

সত্যি কথা বলতে ক্যান্সারের চিকিৎসা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তার উপর রোগীর Survival Rate নিয়েও প্রশ্ন জাগে এবং বিভিন্ন দ্বিধা সংকোচ তৈরি হয়, টাকা খরচ করেও; রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? তবে একটা ভরসা বা আশার আলো হচ্ছে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে এবং সঠিক চিকিৎসা পাওয়া গেলে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম এবং রোগী ইনশা-আল্লাহ দীর্ঘকাল সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারেন, এটা শুনতে অবাক লাগলেও আমার বিচার-বিশ্লেষণে তাই বলে। মানে খুব সহজ ভাষায় বললে, দেহের যে জায়গায় বা স্থানে ক্যান্সারের কোষ থাকে সেটা যদি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে সেটা কিছুটা হলেও ঝুঁকিমুক্ত। তবে, দেহের হাড় বা অভ্যন্তরীণ অথবা সংবেদনশীল জায়গাসমূহ বাদে! তার মধ্যে স্তন সেই রকমই একটা অংশ। আপনার ক্যান্সার যদি সেটা স্তন পর্যন্তই থেকে থাকে আর শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে না থেকে থাকে, তাহলে ইনশা-আল্লাহ আপনি প্রাথমিক অবস্থায় অপারেশনের মাধ্যমে শংকামুক্ত। আর যদি সেটা লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে থাকে কিন্তু শরীরের অন্য কোন স্থানে না ছড়িয়ে থেকে থাকে [আর এটাই প্রায়শই রোগীর সাথে ঘটে থাকে আর আমার আত্মীয়ার সাথেও তাই-ই ঘটেছিল], তাহলে আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা'য়ালা চাইলে আপনি কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির কিছু সাইকেল বা কোর্স সম্পন্ন করার পর লিম্ফ নোড হয়ে যেনো শরীরের অন্য কোথাও না ছড়ায়, সে জন্য ৩ থেকে ৬ মাস অন্তর অন্তর একজন অভিজ্ঞ অনকোলজিস্টের পরামর্শ আর পরীক্ষার মাধ্যমে দীর্ঘকাল ইনশা-আল্লাহ বেঁচে থাকা সম্ভব।
তবে সমস্যা এখানে অন্য জায়গায়! সেটা হলো বিশেষ করে আমাদের দেশের ক্যান্সারের বেশিরভাগ রোগীই মারা যায় ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ মেটাতে বা বহন করতে না পেরে (চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ব্যয় সম্পর্কে আমার আত্মীয়ার চিকিৎসক প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসায় প্রথম ১২-১৮ মাস আনুমানিক ৮-১০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তবে রোগের পর্যায় ও জটিলতা অনুযায়ী এই ব্যয় আরও কমতে অথবা বৃদ্ধি পেতে পারে - বিশেষত যদি কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়), ধৈর্য্য ধারণ বা মনোবল শক্তি হারানো এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের কারণেই বেশিরভাগ রোগীরই মৃত্যু ঘটে! আর এটাই বাস্তব সত্য।


🎗একটি ভুল পদক্ষেপ আর ভাগ্যবদল

যাইহোক, যেই প্রসঙ্গে এতো কথা; সেই চিকিৎসার ব্যয় কুলাতে না পেরে ২-৩টা কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির সাইকেল দেওয়ার পর ডেলটা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে ৪ থেকে ৫ মাসের মাথায় আমার সেই নিকট আত্মীয়াকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (NICRH), পরিচিত লবিঙের মাধ্যমে ভর্তি করানো হয়। এইরকম করে কিছুদিন ২-৩টার মতো কেমো আর রেডিওথেরাপির সাইকেল চলার পর কোন একটা সময়ে সেখানের ডিউটি ডাক্তার আর আত্মীয়ার পরিবার চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়ে; পুনরায় সেই হাসপাতাল থেকে নিয়ে ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়, অনেকটা ধোঁয়াশা করেই!

(বলে রাখা ভালো এটা পরিষ্কার না যে, এখানে ডাক্তারের পরামর্শে নাকি রোগীর পরিবারের ইচ্ছাতেই যাওয়া হয়েছে! তাই সেই ডাক্তারের হাসপাতাল এবং চেম্বারের কথা গোপন রাখা হলো! তবে এখানে আমার ডাক্তারের চাইতে পরিবারের দোষটাই চোখে পড়েছে, সেটা একটু পরেই বলছি আর এতটা লিখা পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই অনুধাবন করার কথা)

তারপর সেখানে প্রায় ২ বছর চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলার পর ২০২৩ সালের কোন এক জুলাইয়ের কোন একটা সময়ে জানতে পারি তার ক্যান্সারটি তার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়েছে! অথচ রোগীর সেই বছরের ডিসেম্বর ২০২২, কি জানুয়ারির ২০২৩; শেষ রিপোর্ট অব্দি ভালো ছিল, যেটা X-RAY এবং CT-SCAN এর রিপোর্ট প্রমাণ হিসেবে ছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে সেই বছরেই ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে তার কিছুটা শ্বাসকষ্ট আর বুক ভার লাগা শুরু হয় এবং মার্চ মাসের এক্স-রে তে খুবই ছোট আকারের কিছু Nodule ধরা পড়ে! কিন্তু সেখানেও জুলাই অব্দি এই রিপোর্টের ব্যাপারে ডাক্তার নাকি তার পরিবারের অজ্ঞতার কারণে কোন প্রকার কেন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি, এটা নিয়ে প্রশ্ন করেও কোন সদোত্তর না পেয়ে চুপ হয়ে যাই! জুলাইতে রোগীর শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে যাওয়ায় তখন পুনরায় রিপোর্ট করানো হয় এবং আবারও রিপোর্ট খুব খারাপ আসে! সেখানে মার্চের সেই ছোট বা ক্ষুদ্র আকারের নডিউলদের মধ্যে একটা Nodule ৪.২ সেঃমিঃ আকারে ধারণ করেছে! তারপর সেই রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (NICRH) এর মেডিকেল মেডিসিন অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান Professor Dr. Nazrina Khatun - এর কাছে আমি নিয়ে যাই। সেই দিনটা আসলে আমার জীবনে কখনো না আসলেই হয়তো আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম! কারণ এই দিনেই আমি জানতে পারি আমার পরিচিতা রোগীর চিকিৎসা ঠিক মতো হয় নি এবং যেটা উপরে আমি লিখায় উল্লেখ করেছি (এই ডাক্তারকে আমি মন থেকে সম্মান জানাই, কারণ মা'শ-আল্লাহ উনি এতটা আন্তরিক ছিলেন যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না। আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়া'লার কাছে আমি উনার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি)। যাইহোক, ডাক্তার আমার রোগীর সমস্ত ইতিহাস ঘেটে তার ঠিকঠাক মতো চিকিৎসা না করানোর জন্য আজকের এই ফুসফুসে ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়ার কথাটি এবং সরকারি ও ডেলটা হাসপাতালের সঠিকভাবেই চিকিৎসা হচ্ছিলো উল্লেখ করেন। তারপর ডাক্তারের সাথে কথা বা পরামর্শ করার পরে আমরাও বুঝে যাই যে, তাকে মানে রোগীকে আমরা আর খুব বেশিদিন কাছে পাবো না! তারপর রোগীকে উন্নত চিকিৎসার চিন্তা করে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, যদিও জানতাম এটা অহেতুক!

[বলে রাখা ভালো, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (NICRH); এটা যে একটা হাসপাতাল সেটা আমার বলতেও বিবেকে বাঁধে! সবার আগে প্রশ্ন জাগে, এখানে যে সকল দেশের নামকরা বা সম্মানিত চিকিৎসকেরা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন; তাদের সেখানে কি করে রুচী হয় এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে রোগীদের সেবা দান করতে এবং তার উপর এই হাসপাতাল একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। জানি না বর্তমানে ২০২৫ সালে এসে হাসপাতালের সামান্যতম পরিবর্তন হয়েছে কি না। সেটা হাসপাতাল না বলে, কোন বাজারে থাকা ফার্মের মুরগীর খোঁয়াড় নয়তোবা মাছের বাজার বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না!! কারণ প্রথম থেকে তৃতীয় তলা অব্দি অন্ধকার, একটা রোগীর সাথে অসংখ্য দর্শনার্থী, নোংরা পরিবেশ আর সে জায়গার চিকিৎসক থেকে শুরু করে হাসপাতালের স্টাফ প্রায় সবারই ব্যবহার খারাপ এবং যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে! কিন্তু তারা চাইলে এখানে শুধুমাত্র রোগীর সাথে আসা ভিজিটর বা সহযোগী হাসপাতালের সেসকল জায়গায় অ্যাক্সেস দেওয়া, যেহেতু এখানে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল আর স্বল্প জ্ঞানের মানুষেরাই চিকিৎসা নিতে এসে থাকে, তাই উচিৎ ধৈর্য্য আর ভালো আচরণের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা। এখানে কেউ খুশিমনে আসে না! খুব অসহায় হয়েই এখানে দারস্থ হয়! তাই এগুলো বিবেচনায় আনা খুবি প্রয়োজন আর দরকার।
তবে বলে রাখা ভালো, তাদের কেমোথেরাপি দেওয়ার রুমে যেহেতু শুধুমাত্র রোগী আর নার্স-ডাক্তারদের জন্য এক্সেস থাকে, তাই সেই জায়গাটা তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার]


🎗গল্পের অপ্রত্যাশিত অধ্যায়

তারপর রোগীর শারীরিক দিক থেকে আস্তে আস্তে অবনতির দিকে যেতে থাকে এবং ইন্তেকাল করার আগ অব্দি প্রায় মাস তিনেক নিয়মিত অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে চলতে হয়েছিলো। এই ধরণের রোগী দেখা যে কতটা মানসিক দুর্বিষহ আর অসহনীয় যন্ত্রণার, তা আমার কোন পরিচিত শত্রু অথবা অপরিচিত মানুষের মধ্যেও দেখতে কিংবা শুনতেও চাই না! এই ধরনের রোগীর যে কতটা কষ্ট হয়, তা আপনি আপনার সুস্থ শরীরে নিজের শ্বাস একটা পর্যায় পর্যন্ত আটকে পরীক্ষা করতে পারেন! আমার দেখা ও ভাষ্যমতে দুনিয়ায় অনেক কষ্টদায়ক মৃত্যুর মধ্যে সবার উপরে হয়তো, শ্বাসকষ্ট অথবা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত রোগীরাই সবার এবং শীর্ষস্থানে থাকবে!

অতঃপর, ২০২৪ সালের আগস্টের প্রায় মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আমার সেই পরিচিতা রোগী আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়া'লার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান। রেখে যান তার স্বামী এবং দুইটা ছোট ছেলে। বিশেষ করে ছোট ছেলেটার জন্য আমার সেই আত্মীয়ার প্রতিনিয়ত খুব করে আল্লাহর কাছে আকুতি ও দোয়া চাইতেন বেঁচে থাকার জন্য! কিন্তু আল্লাহ আজ্বওয়াজাল নিঃসন্দেহে উত্তম পরিকল্পনাকারী। উনার শুধুমাত্র ক্যান্সারকে ঘিরে প্রায় ৫টি বছরে অনেক অজস্র না বলা কথা বা গল্প এখানে আমি আপনাদের লিখে বলেও হয়তো শেষ করা সম্ভব না! যেহেতু একটা বিষয়কে ঘিরে এখানে লিখতে হয়েছে, তাই যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বুঝিয়ে লিখার চেষ্টা করেছি। এই জন্যই শুরুতেই বলেছি “এই যুদ্ধে শুধু রোগী নন, লড়াই করে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, আশা আর বাস্তবতার কঠিন টানাপোড়েন।” আপনারা যারা এতক্ষণ ধৈর্য্য নিয়ে এই লিখাটা পড়েছেন তারা আমার সেই আত্মীয়ার জন্য দোয়া করবেন। তিনি নিঃসন্দেহে একজন প্রকৃতার্থে ভালো মানুষ ছিলেন, সেটা আমার পরিচিতা বলেই বলছি না; আসলেও ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের রব যেনো তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন (আমিন)। আর আপনারা এই লিখা যে বা যারা যেই উদ্দেশ্য নিয়েই আসুন না কেন, আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা'য়ালা আপনাদের সর্বদা মঙ্গল করুন এবং সুস্থতা দান করুন (আমিন)।


🎗 প্রাপ্ত শিক্ষা ও বার্তা

এই অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাদের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাঃ

  • শরীরের যেকোনো অস্বাভাবিক চাকা বা পরিবর্তন অবহেলা করবেন না।

  • প্রাথমিক অবস্থাতেই সঠিক চিকিৎসা নিলে বাঁচার সম্ভাবনা ইনশা-আল্লাহ অনেক বেশি।

  • অর্ধেক চিকিৎসা বন্ধ করা বিপজ্জনক—নিয়মিত ফলোআপ আবশ্যক।

  • পরিবারের মানসিক শক্তি রোগীর জীবনে আশার আলো হতে পারে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় দেখা গেছে, সাইকোসোশিয়াল সাপোর্ট পেয়ে এমন ক্যান্সার রোগীদের বেঁচে থাকার হার ৪০% বেশি (Psycho-Oncology, ২০২১)।

  • ক্যান্সার হলে আর্থিক পরিকল্পনা খুবই প্রয়োজন! তাই প্রথমেই ঘাবড়ে না গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে এবং দুশ্চিন্তা না করে, রোগীকে সাহস, মনোবল দিয়ে সহায়তা করুন এবং চিকিৎসক অথবা বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ নিয়ে রোগীর বা আপনার খরচের একটা পরিকল্পনা সাজান। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, "তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কারণ আল্লাহ তা'আলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি।


পরবর্তীতে যে সকল বিষয়বস্তুর উপর আলোচনা থাকবেঃ


এখানে আমরা ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে নিম্নলিখিত ধাপগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা করবোঃ

  • ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার কী?

    • সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
    • স্তনের শারীরস্থান/ গঠন বা কাঠামো

  • বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রকোপ ও পরিসংখ্যান

    • দেশের ব্রেস্ট ক্যান্সার পরিস্থিতি
    • আন্তর্জাতিক তুলনা

  • স্তন ক্যান্সারের কারণ ও ঝুঁকি উপাদান

    • অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি উপাদান
    • পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি উপাদান
    • জেনেটিক কারণ

  • ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ

    • প্রাথমিক লক্ষণ
    • উন্নত পর্যায়ের লক্ষণ
    • কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

  • ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয় ও পরীক্ষা পদ্ধতি

    • শারীরিক পরীক্ষা ও স্তন স্ব-পরীক্ষা
    • ইমেজিং পরীক্ষাঃ Mammogram, Ultrasound, MRI
    • বায়োপসি ও তার প্রকারভেদ
    • অন্যান্য ল্যাব পরীক্ষা

  • ব্রেস্ট ক্যান্সারের পর্যায় ও শ্রেণীবিভাগ

    • টিউমার আকার, নোড ও মেটাস্ট্যাসিস
    • সামগ্রিক পর্যায়
    • বায়োমার্কার ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ

  • ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি

    • সার্জারিঃ Lumpectomy, Mastectomy
    • রেডিয়েশন থেরাপি
    • কেমোথেরাপি
    • হরমোন থেরাপি
    • টার্গেটেড থেরাপি
    • ইমিউনোথেরাপি
    • পুনর্গঠনমূলক সার্জারি

  • স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা

    • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
    • নিয়মিত স্ক্রিনিং ও সচেতনতা
    • ঝুঁকি কমানোর কৌশল
    • দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাপনা

  • ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও রোগের পূর্বাভাস

    • চিকিৎসার পর জীবনকাল ও সুস্থতার হার

  • স্তন ক্যান্সার নিয়ে জীবনযাপন

    • মানসিক ও শারীরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
    • সহায়তা গোষ্ঠী ও কাউন্সেলিং
    • পুনর্বাসন ও সুস্থ জীবনযাপন

  • উপসংহার

  • গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সতর্কবার্তা

  • FAQ


১. ব্রেস্ট ক্যান্সার কী?


ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার হলো এমন একটি রোগ যেখানে স্তনের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এটি এক ধরনের Malignant Tumour যা স্তন টিস্যুর মধ্যে তৈরি হয় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার (Metastasis) ক্ষমতা রাখে। এই রোগ সাধারণত স্তন থেকে উৎপত্তি লাভ করে, তবে সময়মতো ধরা না পড়লে এটি Lymph Nodes এবং পরবর্তীতে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে ফুসফুস, হাড়, যকৃত বা মস্তিষ্কের মতো দূরবর্তী অঙ্গগুলিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।


🎗সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

ব্রেস্ট ক্যান্সার বলতে সাধারণত একগুচ্ছ রোগের সমষ্টিকে বোঝায় যা বিভিন্ন ধরনের কোষ থেকে উদ্ভূত হতে পারে এবং বিভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রধান প্রকারভেদগুলো হলোঃ

  • Ductal Carcinoma In Situ - DCIS: এটি নন-ইনভেসিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি রূপ, যেখানে অস্বাভাবিক কোষগুলো শুধুমাত্র দুধ বহনকারী নালীগুলির (Milk Ducts) আস্তরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং স্তনের অন্যান্য অংশে বা শরীরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে না। এটি প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সার হিসেবে বিবেচিত এবং সময়মতো চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।

  • Invasive Ductal Carcinoma - IDC: এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, যা প্রায় ৮০% ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষগুলো দুধ বহনকারী নালীগুলির আস্তরণ ভেদ করে স্তনের আশেপাশের টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। এখান থেকে ক্যান্সার লিম্ফ নোড বা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে।

  • Invasive Lobular Carcinoma - ILC: এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের দ্বিতীয় সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, যা প্রায় ১০-১৫% ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই ক্যান্সার স্তনের দুধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি বা Lobules থেকে শুরু হয় এবং পার্শ্ববর্তী টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। ILC প্রায়শই IDC-এর মতো স্পষ্ট পিণ্ড তৈরি করে না, যা এর নির্ণয়কে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

  • Inflammatory Breast Cancer - IBC: এটি একটি বিরল কিন্তু অত্যন্ত আগ্রাসী ধরনের ব্রেস্ট ক্যান্সার, যা স্তনকে লাল, ফোলা এবং গরম করে তোলে, অনেকটা সংক্রমণের মতো। এটি স্তনের লিম্ফ্যাটিক ভ্যাসেলগুলিকে ব্লক করে, যার ফলে ত্বক কমলালেবুর খোসার মতো (Peau d'orange) দেখায়। দ্রুত নির্ণয় এবং চিকিৎসা জরুরি।

  • Paget's Disease of the Nipple: এটি একটি বিরল ক্যান্সার যা স্তনবৃন্তের ত্বক এবং অ্যারিওলাকে প্রভাবিত করে, যার ফলে চুলকানি, লালভাব, ফ্লেকিং এবং ক্রাস্টিং হতে পারে। এটি প্রায়শই অন্তর্নিহিত ডাক্টাল কার্সিনোমার সাথে যুক্ত থাকে।

  • Triple-Negative Breast Cancer - TNBC: এই প্রকারের ক্যান্সার ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর, প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর এবং HER2 প্রোটিনের জন্য নেগেটিভ হয়। এর মানে হলো এটি হরমোন থেরাপি বা HER2-টার্গেটেড থেরাপিতে সাড়া দেয় না, এবং এটি প্রায়শই আক্রমণাত্মক হয় এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়।


🎗স্তনের শারীরস্থান (Anatomy of Breast)

স্তনের সঠিক শারীরস্থান বোঝা ব্রেস্ট ক্যান্সার কীভাবে বিকশিত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে তা বুঝতে সাহায্য করে। স্তন প্রধানত তিনটি অংশ নিয়ে গঠিতঃ

  • Lobules: লোবিউল হলো দুধ উৎপাদনের ক্ষুদ্র গ্রন্থি, যা স্তনের ভেতরে ছোট ছোট খণ্ডে (লোবে) ভাগ হয়ে থাকে।

  • Ducts: এগুলি পাতলা টিউব যা লোবিউল থেকে দুধকে স্তনবৃন্তের (Nipple) দিকে নিয়ে যায়।

  • Connective Tissue: এটি Fibrous এবং ফ্যাটি টিস্যু দিয়ে গঠিত যা লোবিউল এবং ডাক্টগুলিকে ঘিরে থাকে এবং তাদের ধরে রাখে। এটি স্তনকে তার আকার দেয়।

এছাড়াও, স্তনের চারপাশে রক্তনালী, স্নায়ু এবং Lymphatic Vessels থাকে। লিম্ফ্যাটিক ভ্যাসেলগুলি লিম্ফ নোডগুলিতে (বিশেষ করে বগলের নিচে) তরল বহন করে, যা ক্যান্সারের কোষ ছড়িয়ে পড়ার একটি সাধারণ পথ। এই জটিল গঠনতন্ত্রের যেকোনো অংশেই ক্যান্সার কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শুরু হতে পারে।


২. বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রকোপপরিসংখ্যান


ব্রেস্ট ক্যান্সার (Breast Cancer) কেবল একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বাংলাদেশেও এর প্রকোপ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলির তুলনায় বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিত্র অনেক বেশি উদ্বেগজনক, কারণ এখানে প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের হার কম এবং সচেতনতার অভাব প্রকট।


🎗দেশের ব্রেস্ট ক্যান্সার পরিস্থিতি

বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঠিক ও হালনাগাদ জাতীয় পরিসংখ্যানের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল-ভিত্তিক গবেষণা, ক্যান্সার রেজিস্ট্রি এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের তথ্য থেকে একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়ঃ

  • ক্রমবর্ধমান প্রবণতাঃ বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীর মতো বড় শহরগুলিতে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, নগরায়ন এবং খাদ্যাভ্যাস এর পেছনে অন্যতম কারণ।

  • আক্রান্তের সংখ্যাঃ বেসরকারি হিসাব এবং ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর আনুমানিক ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ নতুন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যদিও এই সংখ্যাটি সরকারিভাবে নিশ্চিত করা কঠিন, তবে এটি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করছে।

  • মৃত্যুহারঃ বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের উচ্চ মৃত্যুহার একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। এর অন্যতম কারণ হলো দেরিতে রোগ নির্ণয়। বেশিরভাগ রোগীই উন্নত পর্যায়ে (stage III বা IV) যখন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে, তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। অসচেতনতা, কুসংস্কার, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং দূরবর্তী এলাকায় চিকিৎসা সুবিধার অভাব এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখে।

  • বয়স বন্টনঃ যদিও বিশ্বব্যাপী ব্রেস্ট ক্যান্সার সাধারণত বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম বয়সী নারীদের মধ্যেও ব্রেস্ট ক্যান্সারের হার বাড়ছে। ৩০-৫০ বছর বয়সী নারীরাও ক্রমবর্ধমান হারে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

  • জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (NICRH): এটি বাংলাদেশের প্রধান ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানকার তথ্যে দেখা যায়, নারীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারই সবচেয়ে বেশি নির্ণয়কৃত ক্যান্সার। রোগীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ে নির্ণয়ের প্রবণতা বেশি।


🎗আন্তর্জাতিক তুলনা

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন।

  • উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনাঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রকোপ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হতে পারে, কিন্তু সেখানে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (যেমন নিয়মিত ম্যামোগ্রাম) অত্যন্ত শক্তিশালী। এর ফলে রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে এবং চিকিৎসার সাফল্যের হার অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিক পর্যায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার ৯০% এর বেশি।

  • উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে তুলনাঃ আফ্রিকার কিছু দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিত্র সাদৃশ্যপূর্ণ। এই দেশগুলিতেও সচেতনতার অভাব, দেরিতে রোগ নির্ণয় এবং দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো উচ্চ মৃত্যুহারের কারণ।

  • WHO এর তথ্যঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর গ্লোবোক্যান (GLOBOCAN) ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৮ জন নারীর মধ্যে ১ জন তাদের জীবদ্দশায় ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সামগ্রিকভাবে, এটি ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। বাংলাদেশে, এই হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, দেরিতে রোগ নির্ণয়ের কারণে মৃত্যুহার বেশি।

  • ঝুঁকি উপাদানঃ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেক ঝুঁকি উপাদান, যেমনঃ স্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অ্যালকোহল সেবন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল ইত্যাদি বাংলাদেশেও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তবে জিনগত কারণ এবং পারিবারিক ইতিহাস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ।

সংক্ষেপে, বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে এবং এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক রোগ নির্ণয়, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উন্নত চিকিৎসা সুবিধার প্রসার এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


৩. স্তন ক্যান্সারের কারণঝুঁকি উপাদান


স্তন ক্যান্সার (Breast Cancer) একটি জটিল রোগ, এবং এর একক কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। বরং, এটি বিভিন্ন জেনেটিক, হরমোনাল, জীবনযাত্রার এবং পরিবেশগত কারণের সম্মিলিত প্রভাবে বিকাশ লাভ করে। কিছু ঝুঁকি উপাদান (Risk Factors) ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে, যা দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি উপাদান (Non-Modifiable Risk Factors) যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এবং পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি উপাদান (Modifiable Risk Factors) যা জীবনযাত্রার পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত করা যায়।


🎗অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি উপাদান

এই কারণগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তবে এদের সম্পর্কে জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এরা রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং কিছু ক্ষেত্রে নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

  • লিঙ্গঃ

    • নারীদের উচ্চ ঝুঁকিঃ নারীরা পুরুষদের তুলনায় ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রেও ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে, তবে তা খুবই বিরল (মোট ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রায় ১%)। নারীদের শরীরে Estrogen এবং Progesterone হরমোনের উপস্থিতি, যা স্তনের কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে, এর অন্যতম কারণ।

  • বয়সঃ

    • বয়স বৃদ্ধিঃ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। ৪০ বছর বয়সের আগে ব্রেস্ট ক্যান্সার বিরল, তবে বয়স যত বাড়ে, ঝুঁকি তত বাড়ে।

  • জেনেটিক্স ও পারিবারিক ইতিহাসঃ

    • BRCA1 ও BRCA2 জিন মিউটেশনঃ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জিনগত কারণে হতে পারে। BRCA1 এবং BRCA2 (Breast Cancer Gene 1 And 2) জিনের মিউটেশন ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। এই জিনগুলো কোষের ডিএনএ মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
    • পারিবারিক ইতিহাসঃ যদি পরিবারের প্রথম-স্তরের আত্মীয়দের (মা, বোন, কন্যা) ব্রেস্ট ক্যান্সার বা ওভারিয়ান ক্যান্সার থাকে, বিশেষ করে যদি অল্প বয়সে তাদের ক্যান্সার হয়ে থাকে, তবে একজন ব্যক্তির ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যান্য জিন যেমনঃ CHEK2, ATM, TP53 (Li-Fraumeni syndrome), PALB2 ইত্যাদিও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

  • পূর্বের ব্রেস্ট ক্যান্সার বা অন্যান্য ক্যান্সারঃ

    • যদি একজন নারীর পূর্বে এক স্তনে ক্যান্সার হয়ে থাকে, তাহলে অন্য স্তনে বা একই স্তনে আবার ক্যান্সার হওয়ার (Second Primary Breast Cancer) ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

  • কিছু প্রকারের নিরীহ স্তন রোগঃ

    • কিছু নির্দিষ্ট ধরনের অ-ক্যান্সারযুক্ত (Benign) স্তন রোগ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য বাড়াতে পারে। যেমনঃ Atypical Hyperplasia, এবং Lobular Carcinoma in Situ - LCIS - যদিও LCIS নিজেই ক্যান্সার নয়, এটি ভবিষ্যতের ক্যান্সারের ঝুঁকির একটি সূচক।

  • ঘন স্তন টিস্যুঃ

    • যাদের স্তনে Adipose (চর্বি) টিস্যুর চেয়ে Fibroglandular (গ্রন্থিময় ও তন্তুময়) টিস্যু বেশি থাকে, তাদের স্তনকে "ঘন স্তন" বলা হয়। ঘন স্তন যাদের, তাদের ম্যামোগ্রামে ক্যান্সার শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে এবং তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি থাকে।

  • রেডিয়েশন এক্সপোজার (Radiation Exposure):

    • যদি শৈশব বা কৈশোরে বুক বা বক্ষপিঞ্জরে (Chest) রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়া হয় (যেমন - Hodgkin's Lymphoma চিকিৎসার জন্য), তাহলে ভবিষ্যতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।


🎗পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি উপাদান

এই কারণগুলো আমাদের জীবনযাত্রার ধরন এবং পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত, যা পরিবর্তন করে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

  • স্থূলতা ও ওজন বৃদ্ধিঃ

    • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, বিশেষ করে Menopause পরে, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। মেনোপজের পর, চর্বি কোষগুলো ইস্ট্রোজেন উৎপাদন করে, যা কিছু ব্রেস্ট ক্যান্সারের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। স্থূলতা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এবং প্রদাহও বাড়ায়, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে সহায়ক।

  • শারীরিক নিষ্ক্রিয়তাঃ

    • নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের অভাব ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার বা ৭৫ মিনিট উচ্চ-তীব্রতার ব্যায়াম এই ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

  • অ্যালকোহল বা মদ সেবনঃ

    • অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে অ্যালকোহল সেবনও ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

  • হরমোন থেরাপি (Hormone Replacement Therapy - HRT):

    • মেনোপজের লক্ষণগুলি (যেমনঃ হট ফ্ল্যাশ, রাতের ঘাম) উপশমের জন্য ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের সংমিশ্রণ থেরাপি (Combined HRT) ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি ব্যবহারের সময়কাল বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে।

  • জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিলঃ

    • কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল সেবন ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য বাড়াতে পারে, তবে সামগ্রিক ঝুঁকি খুবই কম। পিল বন্ধ করার পর এই ঝুঁকি সাধারণত কমে যায়।

  • প্রথম গর্ভধারণের বয়স ও স্তন্যপানঃ

    • যদি একজন নারী ৩৫ বছর বয়সের পর প্রথম সন্তান ধারণ করেন, তবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বাড়ে।
    • স্তন্যপান করানোঃ যেসব মা স্তন্যপান করান না, তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি থাকে। স্তন্যপান করানো ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে, কারণ এটি স্তনের কোষগুলোকে পরিপক্ক হতে সাহায্য করে এবং ইস্ট্রোজেনের এক্সপোজার কমায়।

  • ধূমপানঃ

    • ধূমপান সরাসরি ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি শক্তিশালী কারণ না হলেও, এটি ক্যান্সারের সামগ্রিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। কিছু গবেষণা ধূমপান এবং ট্রিপল-নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের মধ্যে একটি যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে।

  • পরিবেশগত রাসায়নিক পদার্থঃ

    • কিছু পরিবেশগত রাসায়নিক পদার্থ, যেমন Endocrine Disruptors যা ইস্ট্রোজেনের মতো কাজ করে (যেমন কিছু কীটনাশক, Bisphenol এ বা BPA), ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তবে এই বিষয়ে গবেষণা এখনও চলমান এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সীমিত।

  • রাতে কৃত্রিম আলোর প্রভাবঃ

    • কিছু গবেষণা ইঙ্গিত করে যে যারা রাতের শিফটে কাজ করেন এবং কৃত্রিম আলোর সংস্পর্শে থাকেন, তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি হতে পারে, কারণ এটি মেলাটোনিন (Melatonin) উৎপাদনকে ব্যাহত করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধী প্রভাব ফেলে।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ এবং ঝুঁকি উপাদানগুলো সম্পর্কে জানা প্রতিটি মানুষের জন্য, বিশেষ করে নারীদের জন্য, অত্যন্ত জরুরি। এই জ্ঞান তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।


৪. ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ


ব্রেস্ট ক্যান্সারের (Breast Cancer) লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে এবং সবসময় স্পষ্ট নাও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে, কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে এবং নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে রোগটি ধরা পড়ে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে, যা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। মনে রাখা প্রয়োজন, এই লক্ষণগুলো ব্রেস্ট ক্যান্সার ছাড়াও অন্যান্য নিরীহ (Benign) স্তন সমস্যার কারণেও হতে পারে। তবে যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।


🎗প্রাথমিক লক্ষণ

প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সার - এর সিম্পটমস বা লক্ষণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সেগুলো হলোঃ

  • স্তনে পিণ্ড বা চাকা (Lump or Mass in the Breast):

    • এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। স্তনের যেকোনো অংশে বা বগলের নিচে একটি নতুন পিণ্ড বা চাকা অনুভব করা যেতে পারে।
    • এই পিণ্ড সাধারণত শক্ত, ব্যথাহীন এবং অনিয়মিত আকারের হতে পারে, যা টিপলে সহজে নড়ে না।
    • তবে সব পিণ্ডই ক্যান্সার নয়; সিস্ট ( সিস্ট - তরলপূর্ণ থলি) বা ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা (ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা - নিরীহ টিউমার) সহ আরও অনেক নিরীহ কারণের জন্যেও পিণ্ড হতে পারে। কিন্তু যেকোনো নতুন পিণ্ড অনুভব করলে চিকিৎসকের দ্বারা পরীক্ষা করানো অত্যাবশ্যক।

  • স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তনঃ

    • একটি স্তনের আকার বা আকৃতির হঠাৎ পরিবর্তন, বা দুটি স্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অসামঞ্জস্য।
    • স্তনের একটি অংশে বা সম্পূর্ণ স্তনে ফোলাভাব দেখা যেতে পারে, এমনকি পিণ্ড অনুভব না হলেও।

  • স্তনের ত্বকের পরিবর্তনঃ

    • লালচে ভাব বা ডিসকালারেশন (Redness or Discoloration): স্তনের ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া বা কালশিটে পড়ার মতো দেখা যাওয়া।
    • কমলালেবুর খোসার মতো ত্বকঃ স্তনের ত্বক ঘন হয়ে যাওয়া, টোল পড়া বা লোমকূপগুলো প্রসারিত হয়ে কমলালেবুর খোসার মতো অমসৃণ ও খসখসে দেখা যাওয়া। এটি সাধারণত প্রদাহজনক ব্রেস্ট ক্যান্সারের (Inflammatory Breast Cancer) একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
    • ত্বকে টোল পড়া বা ভেতরের দিকে টেনে যাওয়াঃ স্তনের ত্বকে গর্ত বা কুঁচকে যাওয়ার মতো পরিবর্তন, বা ত্বকের কোনো অংশ ভেতরের দিকে টেনে যাওয়া।

  • স্তনবৃন্তের পরিবর্তন (Nipple Changes):

    • স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া (Nipple Retraction): যদি স্তনবৃন্ত সম্প্রতি ভেতরের দিকে ঢুকে যায় বা তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে পরিবর্তিত হয়।
    • স্তনবৃন্ত থেকে অস্বাভাবিক নিঃসরণ (Nipple Discharge): স্তনবৃন্ত থেকে রক্তযুক্ত, পরিষ্কার বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক তরল নিঃসরণ, বিশেষ করে যদি তা এক স্তন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় এবং চাপ ছাড়া হয়।
    • স্তনবৃন্তের চারপাশে চুলকানি, ফুসকুড়ি বা ক্ষত (Itching, Rash, or Soreness around Nipple): স্তনবৃন্ত বা অ্যারিওলার (Areola - স্তনবৃন্তের চারপাশের কালো অংশ) ত্বকেPersistent ফুসকুড়ি, ঘা, বা চুলকানি যা সাধারণ চিকিৎসার পরও ভালো হয় না। এটি পেজেট'স ডিজিজ (Paget's Disease) এর লক্ষণ হতে পারে।


🎗উন্নত পর্যায়ের লক্ষণ (Advanced Signs)

যদি ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় না হয় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে (Metastasis), তাহলে আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারেঃ

  • বগলে বা কলার বোনের আশেপাশে পিণ্ড বা ফোলাঃ ক্যান্সার কোষ লিম্ফ নোডগুলিতে ছড়িয়ে পড়লে বগলের নিচে বা কলার বোনের (Collarbone) আশেপাশে লিম্ফ নোডগুলো বড় হয়ে যেতে পারে, যা পিণ্ড বা ফোলা হিসেবে অনুভূত হতে পারে।

  • স্তনে ব্যথাঃ যদিও বেশিরভাগ ব্রেস্ট ক্যান্সার ব্যথাহীন হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে স্তনে অবিরাম ব্যথা, সংবেদনশীলতা বা অস্বস্তি হতে পারে, যা মাসিক চক্রের সাথে সম্পর্কিত নয়।

  • হাড়ে ব্যথা , ক্লান্তি, ওজন হ্রাসঃ যদি ক্যান্সার হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে হাড়ে ব্যথা হতে পারে। মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্লান্তি, ক্ষুধা হ্রাস এবং অযাচিত ওজন হ্রাস দেখা যেতে পারে।

  • কাশি বা শ্বাসকষ্টঃ যদি ক্যান্সার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে অবিরাম কাশি, শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা হতে পারে।

  • জন্ডিস বা পেটে ফোলাঃ যদি ক্যান্সার যকৃতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে জন্ডিস (ত্বক বা চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া), পেটে ফোলাভাব বা ব্যথা হতে পারে।


🎗কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

উপরোক্ত যেকোনো লক্ষণ বা স্তনে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এটি ক্যান্সার না হলেও, সঠিক রোগ নির্ণয় এবং প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যদিঃ

  • আপনি একটি নতুন বা অস্বাভাবিক পিণ্ড অনুভব করেন।
  • আপনার স্তনের আকার, আকৃতি বা ত্বকের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়।
  • স্তনবৃন্ত থেকে অস্বাভাবিক নিঃসরণ হয়।
  • বগলে বা কলার বোনের আশেপাশে কোনো ফোলা বা পিণ্ড থাকে।

নিজেই পরীক্ষা করা (Breast Self-Exam) এবং নিয়মিত ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সাম (Clinical Breast Exam) করানো ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো ধরতে সাহায্য করে।


৫. ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়পরীক্ষা পদ্ধতি


ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা একাধিক পদ্ধতির সমন্বয় ঘটান। একজন ব্যক্তির লক্ষণ, পারিবারিক ইতিহাস এবং ঝুঁকির কারণ বিবেচনা করে সঠিক পরীক্ষার পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়।


🎗শারীরিক পরীক্ষা ও স্তন স্ব-পরীক্ষা

নিজের স্তন পরীক্ষা করছেন এক নারী, ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রাথমিক সনাক্তকরণ।
স্তন স্ব-পরীক্ষাঃ নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করুন

  • স্তন স্ব-পরীক্ষা (Breast Self-Exam - BSE):

    • প্রতিটি নারীর জন্য প্রতি মাসে একবার স্তন স্ব-পরীক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস। এটি নিজের স্তনের স্বাভাবিক গঠন এবং অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করে।
    • পদ্ধতিঃ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এবং শুয়ে উভয় অবস্থানেই স্তন ও বগলের নিচের অংশ হাতে অনুভব করে কোনো পিণ্ড, ফোলা, বা ত্বকের পরিবর্তন আছে কিনা তা দেখা উচিত। মাসিক চক্রের ৭-১০ দিন পর, যখন স্তন কম সংবেদনশীল থাকে, তখন এই পরীক্ষা করা সবচেয়ে ভালো।
    • গুরুত্বঃ যদিও BSE দ্বারা প্রতিটি ক্যান্সার ধরা পড়ে না, তবে এটি স্তনে কোনো নতুন বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে।

  • Clinical Breast Exam - CBE:

    • একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী (চিকিৎসক বা নার্স) দ্বারা স্তনের শারীরিক পরীক্ষা।
    • পদ্ধতিঃ চিকিৎসক স্তন এবং বগলের লিম্ফ নোডগুলো পরীক্ষা করে কোনো পিণ্ড বা অন্যান্য অস্বাভাবিকতা অনুভব করেন।
    • সুপারিশঃ ২০-৪০ বছর বয়সী নারীদের প্রতি ১-৩ বছর অন্তর এবং ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের প্রতি বছর একবার CBE করানো উচিত।


🎗ইমেজিং পরীক্ষা (Imaging Tests)

ইমেজিং পরীক্ষাগুলো স্তনের অভ্যন্তরীণ কাঠামো দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় এবং ক্যান্সারের উপস্থিতি বা অস্বাভাবিকতার ইঙ্গিত দিতে পারে।

  • Mammogram:

    • ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্ক্রিনিংয়ের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর পদ্ধতি। ম্যামোগ্রাম হলো স্তনের একটি বিশেষ ধরনের এক্স-রে
    • কার্যকারিতাঃ এটি স্তনের ছোট ছোট পরিবর্তন, যেমন Microcalcifications বা টিউমার শনাক্ত করতে পারে, যা সাধারণত হাতে অনুভব করা যায় না।
    • প্রকারভেদঃ
      • Screening Mammogram: যাদের কোনো লক্ষণ নেই, তাদের মধ্যে ক্যান্সার খুঁজতে ব্যবহৃত হয়।
      • Diagnostic Mammogram: যাদের স্তনে কোনো পিণ্ড বা অস্বাভাবিক লক্ষণ আছে, তাদের ক্ষেত্রে আরও বিস্তারিত ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত হয়।
    • সুপারিশঃ ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের জন্য নিয়মিত (সাধারণত প্রতি বছর বা দুই বছর অন্তর) ম্যামোগ্রাম স্ক্রিনিং সুপারিশ করা হয়। উচ্চ ঝুঁকির ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কম বয়সেও শুরু করা যেতে পারে।

প্রাথমিক অবস্থায় ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করতে ম্যামোগ্রাম মেশিন।
Mammogram Machine


  • Ultrasound:

    • স্তনে পিণ্ড বা অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়। এটি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে স্তনের ভেতরের ছবি তৈরি করে।
    • কার্যকারিতাঃ এটি পিণ্ডের প্রকৃতি নির্ণয়ে সাহায্য করে – যেমন, পিণ্ডটি কঠিন (Solid) টিউমার নাকি তরলপূর্ণ সিস্ট (Cyst)। এটি ঘন স্তন টিস্যুযুক্ত (Dense Breast Tissue) নারীদের ক্ষেত্রে ম্যামোগ্রামের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

  • MRI - Magnetic Resonance Imaging:

    • MRI শক্তিশালী চুম্বক এবং রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে স্তনের বিস্তারিত ছবি তৈরি করে।
    • কার্যকারিতাঃ এটি উচ্চ ঝুঁকির নারীদের (যেমন BRCA জিনের মিউটেশন যাদের আছে) স্ক্রিনিংয়ের জন্য, বা ম্যামোগ্রাম ও আল্ট্রাসাউন্ডে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে আরও বিস্তারিত মূল্যায়নের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। এটি Multifocal বা Multicentric (বহু স্থানে ক্যান্সার) ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করতেও সহায়ক।



🎗বায়োপসি (Biopsy) ও তার প্রকারভেদ

বায়োপসি হলো ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ের সবচেয়ে নিশ্চিত পদ্ধতি। স্তন থেকে টিস্যুর একটি ছোট নমুনা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে (প্যাথোলজি) পরীক্ষা করা হয়, যা ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি নিশ্চিত করে।

  • Fine Needle Aspiration - FNA:

    • একটি পাতলা সূঁচ ব্যবহার করে সন্দেহজনক পিণ্ড থেকে কোষ বা তরল সংগ্রহ করা হয়। এটি সাধারণত সিস্ট থেকে তরল নিষ্কাশনে বা খুব ছোট পিণ্ড থেকে নমুনা নিতে ব্যবহৃত হয়।

  • Core Needle Biopsy - CNB:

    • একটি কিছুটা মোটা, ফাঁপা সূঁচ ব্যবহার করে পিণ্ড থেকে টিস্যুর একাধিক ছোট নমুনা (কোর) সংগ্রহ করা হয়। এটি FNA এর চেয়ে বেশি টিস্যু সরবরাহ করে, যা আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণের সুযোগ দেয়। এটি আল্ট্রাসাউন্ড বা ম্যামোগ্রামের নির্দেশনায় করা যেতে পারে।

  • Vacuum-Assisted Biopsy:

    • একটি বিশেষ সূঁচ ব্যবহার করে ভ্যাকুয়ামের সাহায্যে আরও বড় টিস্যু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এটি ছোট পিণ্ড বা মাইক্রোক্যালসিফিকেশনের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।

  • Incisional/Excisional Biopsy - Surgical Biopsy:

    • Incisional Biopsy: সন্দেহজনক পিণ্ডের একটি অংশ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।
    • Excisional Biopsy: সম্পূর্ণ পিণ্ডটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। এটি সাধারণত তখনই করা হয় যখন অন্যান্য বায়োপসি পদ্ধতি অস্পষ্ট ফলাফল দেয় বা সন্দেহজনক পিণ্ডটি সম্পূর্ণ অপসারণের প্রয়োজন হয়।

  • Lymph Node Biopsy:

    • যদি ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়, তাহলে ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে কিনা তা জানতে বগলের লিম্ফ নোডের বায়োপসি করা হতে পারে।
    • Sentinel Lymph Node Biopsy: এটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। এতে একটি বিশেষ রঞ্জক বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ স্তনে ইনজেকশন করা হয়, যা প্রথম যে লিম্ফ নোডগুলিতে ক্যান্সার ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে (সেন্টিনেল নোড) সেগুলোকে চিহ্নিত করে। এই নোডগুলো অপসারণ করে পরীক্ষা করা হয়।
    • Axillary Lymph Node Dissection: যদি সেন্টিনেল নোডগুলিতে ক্যান্সার পাওয়া যায়, তাহলে বগলের আরও লিম্ফ নোড অপসারণ করা হয়।


🎗অন্যান্য ল্যাব পরীক্ষা

বায়োপসি নমুনা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আরও কিছু ল্যাব পরীক্ষা করা হয়, যা ক্যান্সারের ধরন এবং চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ধারণে সহায়তা করেঃ

  • Hormone Receptor Status - ER/PR Test:

    • ক্যান্সার কোষগুলিতে ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর (Estrogen Receptor - ER) এবং প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর (Progesterone Receptor - PR) আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। যদি ক্যান্সার কোষগুলি এই হরমোন রিসেপ্টর পজিটিভ হয়, তবে হরমোন থেরাপি কার্যকর হতে পারে।

  • HER2 Status:

    • HER2 (Human Epidermal Growth Factor Receptor 2) একটি প্রোটিন যা কিছু ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষের পৃষ্ঠে উপস্থিত থাকে এবং কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে। HER2 পজিটিভ ক্যান্সারগুলি প্রায়শই দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তবে তাদের জন্য নির্দিষ্ট টার্গেটেড থেরাপি (যেমন Trastuzumab) পাওয়া যায়।

  • Genetic Testing:

    • পারিবারিক ইতিহাস বা অন্যান্য ঝুঁকির কারণ থাকলে BRCA1, BRCA2 বা অন্যান্য সম্পর্কিত জিনের মিউটেশনের জন্য জেনেটিক টেস্টিং করা যেতে পারে। এটি শুধুমাত্র ঝুঁকি নির্ণয়েই নয়, কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতেও সহায়তা করে।

  • Multigene Panel Testing:

    • কিছু ক্ষেত্রে, টিউমারের জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করার জন্য মাল্টিজিন প্যানেল টেস্টিং করা হয়, যা রোগের পুনরাবৃত্তি এবং নির্দিষ্ট থেরাপির প্রতি সাড়া কেমন হবে তা পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করে।

এই বিস্তারিত নির্ণয় প্রক্রিয়া ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঠিক পর্যায় (Staging) এবং চিকিৎসার সর্বোত্তম পরিকল্পনা তৈরিতে অপরিহার্য।


৬. ব্রেস্ট ক্যান্সারের পর্যায়শ্রেণীবিভাগ


ব্রেস্ট ক্যান্সারের পর্যায় নির্ধারণের জন্য সাধারণত আমেরিকান জয়েন্ট কমিটি অন ক্যান্সার (American Joint Committee on Cancer - AJCC) দ্বারা প্রস্তাবিত টিএনএম (TNM) স্টেজ সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এটি তিনটি প্রধান উপাদানের উপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের বিস্তারকে মূল্যায়ন করেঃ

  • T (Tumour): প্রাথমিক টিউমারের আকার এবং তার বিস্তার।
  • N (Node): ক্যান্সার কাছাকাছি লিম্ফ নোডগুলিতে (বিশেষ করে বগলের লিম্ফ নোড) ছড়িয়েছে কিনা এবং কতগুলি নোড আক্রান্ত হয়েছে।
  • M (Metastasis): ক্যান্সার শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে (যেমন - ফুসফুস, হাড়, যকৃত, মস্তিষ্ক) ছড়িয়ে পড়েছে কিনা।

এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে ক্যান্সারকে ০ থেকে IV পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়।


🎗টিউমার আকার, নোড ও মেটাস্ট্যাসিস (TNM Staging)


  • T (Tumour): প্রাথমিক টিউমারের আকার ও বিস্তার

'T' উপাদানটি প্রাথমিক টিউমারের আকার এবং এটি স্তনের আশেপাশের টিস্যুতে কতটা ছড়িয়েছে তা নির্দেশ করে।

    • Tis (কার্সিনোমা ইন সিটু - Carcinoma In Situ): এটি ক্যান্সার কোষ যা শুধুমাত্র স্তনের নালী বা লোবিয়ুলের আস্তরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং স্তনের বাইরের অংশে ছড়িয়ে পড়েনি। এটি নন-ইনভেসিভ ক্যান্সার।

      • DCIS (Ductal Carcinoma In Situ): নালীগুলিতে সীমাবদ্ধ।
      • LCIS (Lobular Carcinoma In Situ): লোবিউলগুলিতে সীমাবদ্ধ (যদিও এটি সাধারণত ক্যান্সার নয়, তবে ভবিষ্যতের ঝুঁকির সূচক)।

    • T1: টিউমারের আকার ২ সেমি (প্রায় ০.৮ ইঞ্চি) বা তার কম।

      • T1mi: ০.১ সেমি বা তার কম।
      • T1a: ০.১ সেমি থেকে ০.৫ সেমি।
      • T1b: ০.৫ সেমি থেকে ১ সেমি।
      • T1c: ১ সেমি থেকে ২ সেমি।

    • T2: টিউমারের আকার ২ সেমি এর বেশি কিন্তু ৫ সেমি (প্রায় ২ ইঞ্চি) বা তার কম।

    • T3: টিউমারের আকার ৫ সেমি এর বেশি।

    • T4: টিউমারের আকার যাই হোক না কেন, এটি স্তন প্রাচীরে (Chest Wall) বা ত্বকে ছড়িয়ে পড়েছে, অথবা এটি ইনফ্ল্যামেটরি ব্রেস্ট ক্যান্সার।

  • N (Node): আঞ্চলিক লিম্ফ নোডে বিস্তার

'N' উপাদানটি বোঝায় যে ক্যান্সার কাছাকাছি লিম্ফ নোডগুলিতে, বিশেষ করে বগলের (Axillary) লিম্ফ নোডগুলিতে ছড়িয়েছে কিনা এবং কতগুলি নোড আক্রান্ত হয়েছে।

    • N0: আঞ্চলিক লিম্ফ নোডে ক্যান্সার কোষের কোনো বিস্তার নেই।
    • N1: ১ থেকে ৩টি আঞ্চলিক লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়িয়েছে।
    • N2: ৪ থেকে ৯টি আঞ্চলিক লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়িয়েছে।
    • N3: ১০ বা তার বেশি আঞ্চলিক লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়িয়েছে, অথবা কলার বোনের উপরে/নিচের লিম্ফ নোড বা স্তনের ভেতরের লিম্ফ নোড (Internal Mammary Nodes) আক্রান্ত হয়েছে।

  • M (Metastasis): দূরবর্তী অঙ্গে বিস্তার

'M' উপাদানটি নির্দেশ করে যে ক্যান্সার শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা।

    • M0: শরীরের অন্য কোনো দূরবর্তী অঙ্গে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েনি।
    • M1: শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে (যেমন - ফুসফুস, যকৃত, হাড়, মস্তিষ্ক) ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। এটি চতুর্থ বা মেটাস্ট্যাটিক পর্যায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার।


🎗সামগ্রিক পর্যায় (Overall Stages)

TNM উপাদানের সমন্বয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সামগ্রিক পর্যায় ০ থেকে IV পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়ঃ

  • পর্যায় ০ (Stage 0): DCIS বা LCIS। Non-Invasive ক্যান্সার, যেখানে ক্যান্সার কোষ শুধুমাত্র নালী বা Lobule এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

  • পর্যায় ১ (Stage I): প্রাথমিক এবং তুলনামূলকভাবে ছোট ক্যান্সার।

    • IA: টিউমার ২ সেমি এর কম, কোনো লিম্ফ নোডে বিস্তার নেই।
    • IB: ছোট টিউমার (০.২ সেমি এর বেশি) বা খুব ছোট আকারের টিউমার (২ সেমি এর কম) সাথে ১-৩টি লিম্ফ নোডে মাইক্রোমেটাস্ট্যাসিস (খুব ছোট বিস্তার)।

  • পর্যায় ২ (Stage II): টিউমার কিছুটা বড়, অথবা লিম্ফ নোডে সীমিত বিস্তার।

    • IIA: টিউমার ২ সেমি এর কম কিন্তু ১-৩টি লিম্ফ নোডে বিস্তার, অথবা ২-৫ সেমি আকারের টিউমার কিন্তু কোনো লিম্ফ নোডে বিস্তার নেই।
    • IIB: টিউমার ২-৫ সেমি আকারের এবং ১-৩টি লিম্ফ নোডে বিস্তার, অথবা ৫ সেমি এর বেশি আকারের টিউমার কিন্তু কোনো লিম্ফ নোডে বিস্তার নেই।

  • পর্যায় ৩ (Stage III): স্থানীয়ভাবে উন্নত ক্যান্সার, যা নিকটবর্তী টিস্যু বা লিম্ফ নোডে ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে।

    • IIIA: ৪-৯টি লিম্ফ নোডে বিস্তার, অথবা যেকোনো আকারের টিউমার যা ১০ বা তার বেশি লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে।
    • IIIB: টিউমার স্তন প্রাচীরে বা ত্বকে ছড়িয়েছে, অথবা ইনফ্ল্যামেটরি ব্রেস্ট ক্যান্সার, লিম্ফ নোডে যেকোনো বিস্তার সহ।
    • IIIC: কলার বোনের উপরে/নিচের লিম্ফ নোড বা স্তনের ভেতরের লিম্ফ নোড সহ ১০ বা তার বেশি লিম্ফ নোডে ব্যাপক বিস্তার।

  • পর্যায় ৪ (Stage IV): মেটাস্ট্যাটিক ব্রেস্ট ক্যান্সার, যেখানে ক্যান্সার শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে (যেমন - ফুসফুস, হাড়, যকৃত, মস্তিষ্ক)।


🎗বায়োমার্কার ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ (Biomarker-Based Classification)

আধুনিক ব্রেস্ট ক্যান্সারের শ্রেণীবিভাগ শুধু TNM স্টেজেই সীমাবদ্ধ নয়, টিউমারের জৈবিক বৈশিষ্ট্য (Biomarkers) পরীক্ষাও চিকিৎসার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি ক্যান্সারের আণবিক উপপ্রকার (Molecular Subtypes) নির্ধারণ করে।

  • হরমোন রিসেপ্টর স্থিতি (Hormone Receptor Status - ER/PR Status):

    • ER-পজিটিভ / PR-পজিটিভ (Estrogen Receptor / Progesterone Receptor Positive): যদি ক্যান্সার কোষগুলোতে ইস্ট্রোজেন অথবা প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর থাকে, তবে ক্যান্সার হরমোনের সাহায্যে বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ধরনের ক্যান্সার হরমোন থেরাপির (যেমন - Tamoxifen, Aromatase Inhibitor) প্রতি সাড়া দেয়। এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ প্রকার।
    • ER-নেগেটিভ / PR-নেগেটিভ (Estrogen Receptor / Progesterone Receptor Negative): যদি এই রিসেপ্টরগুলো অনুপস্থিত থাকে, তবে হরমোন থেরাপি কার্যকর হবে না।

  • HER2 স্থিতি (HER2 Status):

    • HER2-Positive: যদি ক্যান্সার কোষগুলিতে HER2 প্রোটিনের মাত্রা বেশি থাকে, তবে ক্যান্সার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং আরও আক্রমণাত্মক হতে পারে। এই ধরনের ক্যান্সার HER2-টার্গেটেড থেরাপির (যেমন - Trastuzumab, Pertuzumab) প্রতি সাড়া দেয়।
    • HER2-Negative: যদি HER2 প্রোটিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে, তবে HER2-টার্গেটেড থেরাপি প্রযোজ্য নয়।

  • Triple-Negative Breast Cancer - TNBC:

    • এটি এমন একটি ক্যান্সার যেখানে ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর, প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর এবং HER2 প্রোটিন—তিনটিই নেগেটিভ থাকে।
    • বৈশিষ্ট্যঃ TNBC সাধারণত আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি হরমোন থেরাপি বা HER2-টার্গেটেড থেরাপিতে সাড়া দেয় না, তাই কেমোথেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি সাধারণত প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি তুলনামূলকভাবে কম বয়সী নারী এবং BRCA1 জিনের মিউটেশন যাদের আছে তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

  • Luminal A/B, HER2-enriched, Basal-like:

    • Gene Expression Profiling এর মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সারকে আরও আণবিক উপপ্রকারে ভাগ করা হয়, যা রোগের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি এবং চিকিৎসার প্রতি সাড়া বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এই বিস্তারিত শ্রেণীবিভাগ এবং স্টেজ নির্ধারণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রতিটি রোগীর জন্য ব্যক্তিগতকৃত (Personalized) এবং সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরিতে চিকিৎসকদের সহায়তা করে।


৭. Breast Cancer Treatment বা ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি


ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য একজন Oncologist (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ), সার্জন, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, প্যাথোলজিস্ট এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের একটি দল সম্মিলিতভাবে কাজ করে। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ


🎗সার্জারিঃ মূল চিকিৎসার ভিত্তি

সার্জারি হলো বেশিরভাগ ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার প্রথম ধাপ এবং সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। এর লক্ষ্য হলো স্তন থেকে ক্যান্সারযুক্ত টিস্যু অপসারণ করা।

  • Lumpectomy/ Breast-Sparing Surgery - BSS:

    • বিবরণঃ এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ এবং তার চারপাশের কিছু সুস্থ টিস্যু (মার্জিন) অপসারণ করা হয়। স্তনের বেশিরভাগ অংশ অক্ষত রাখা হয়।
    • কার জন্যঃ ছোট আকারের টিউমার এবং প্রাথমিক পর্যায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য উপযুক্ত। সাধারণত, লুম্পেক্টমির পর অবশিষ্ট স্তন টিস্যুতে সম্ভাব্য ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়।
    • সুবিধাঃ স্তনের আকৃতি ও অনুভূতি বজায় থাকে, যা রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

  • Mastectomy:

    • বিবরণঃ এই অস্ত্রোপচারে সম্পূর্ণ স্তন অপসারণ করা হয়।
    • প্রকারভেদঃ
      • Simple/Total Mastectomy: স্তন, স্তনবৃন্ত এবং অ্যারিওলা অপসারণ করা হয়, তবে বগলের লিম্ফ নোড বা বুকের পেশী অপসারণ করা হয় না।
      • Modified Radical Mastectomy: সম্পূর্ণ স্তন, স্তনবৃন্ত, অ্যারিওলা এবং বগলের কিছু লিম্ফ নোড (Axillary Lymph Node Dissection) অপসারণ করা হয়। এটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি সাধারণ চিকিৎসা।
      • Nipple-Sparing Mastectomy: সম্পূর্ণ স্তন টিস্যু অপসারণ করা হয়, কিন্তু স্তনবৃন্তঅ্যারিওলা অক্ষত রাখা হয়। এটি কিছু নির্দিষ্ট রোগীর জন্য উপযুক্ত, যেখানে স্তন পুনর্গঠনের পরিকল্পনা থাকে।
    • কার জন্যঃ বড় টিউমার, একাধিক টিউমার, স্থানীয়ভাবে উন্নত ব্রেস্ট ক্যান্সার, বা যাদের লুম্পেক্টমির পর রেডিয়েশন থেরাপি সম্ভব নয়, তাদের জন্য মাস্টেক্টমি সুপারিশ করা হতে পারে।

  • Lymph Node Surgery:

    • Sentinel Lymph Node Biopsy - SLNB: ক্যান্সার ছড়িয়েছে কিনা তা জানতে বগলের প্রথম যে লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে (সেন্টিনেল নোড) তা অপসারণ করে পরীক্ষা করা হয়। যদি এতে ক্যান্সার না থাকে, তবে সাধারণত অন্যান্য লিম্ফ নোড অপসারণের প্রয়োজন হয় না।
    • Axillary Lymph Node Dissection - ALND: যদি সেন্টিনেল নোডে ক্যান্সার কোষ পাওয়া যায় বা অন্য কোনো কারণে লিম্ফ নোডে ব্যাপক বিস্তার থাকে, তবে বগলের আরও লিম্ফ নোড অপসারণ করা হয়।


🎗রেডিয়েশন থেরাপিঃ লক্ষ্যযুক্ত রশ্মি প্রয়োগ

রেডিয়েশন থেরাপিতে (Radiation Therapyউচ্চ-শক্তি সম্পন্ন এক্স-রে বা অন্যান্য বিকিরণ ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত সার্জারির পর অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে বা রোগের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে ব্যবহৃত হয়।

  • বিবরণঃ সাধারণত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন (সপ্তাহে ৫ দিন) নির্দিষ্ট সময় ধরে রেডিয়েশন দেওয়া হয়।
  • কার জন্যঃ লুম্পেক্টমির পর প্রায় সব ক্ষেত্রে, বা মাস্টেক্টমির পর যদি লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়িয়ে থাকে বা টিউমারের আকার বড় হয়, তাহলে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়। এটি ব্যথা উপশম করতেও ব্যবহৃত হতে পারে যদি ক্যান্সার হাড় বা অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
  • প্রকারভেদঃ এক্সটারনাল বিম রেডিয়েশন (External Beam Radiation) সবচেয়ে সাধারণ, যেখানে শরীরের বাইরে থেকে রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্রেকিথেরাপি (Brachytherapy) ব্যবহার করা হয়, যেখানে স্তনের ভিতরে উৎস স্থাপন করা হয়।
ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতিঃ একজন রোগী রেডিয়েশন থেরাপি নিচ্ছেন।
ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপিঃ সুনির্দিষ্টভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া।


🎗কেমোথেরাপিঃ ঔষধ দ্বারা ক্যান্সার ধ্বংস

Chemotherapy হলো ঔষধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার পদ্ধতি। এই ঔষধগুলো ক্যান্সার কোষের দ্রুত বৃদ্ধিকে লক্ষ্য করে কাজ করে।

  • বিবরণঃ কেমোথেরাপি ট্যাবলেট বা শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এটি নির্দিষ্ট চক্রে (Cycle) দেওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসার পর কিছু সময় বিরতি থাকে।
  • কার জন্যঃ
    • Adjuvant Chemotherapy: সার্জারির পর শরীরের অবশিষ্ট ক্ষুদ্র ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে, যা দেখা যায় না কিন্তু ছড়িয়ে থাকতে পারে। এটি রোগের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমায়।
    • Neoadjuvant Chemotherapy: সার্জারির আগে টিউমারের আকার ছোট করতে বা উন্নত পর্যায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সারকে অস্ত্রোপচারের উপযোগী করতে।
    • Metastatic Chemotherapy: যদি ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে (পর্যায় IV), তাহলে জীবনকাল বাড়াতে এবং লক্ষণ উপশম করতে।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, চুল পড়া, রক্তকণিকার সংখ্যা হ্রাস, সংক্রমণ, ইত্যাদি।
কেমোথেরাপিঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি কার্যকর ঔষধীয় পদ্ধতি।
কেমোথেরাপিঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি কার্যকর ঔষধীয় পদ্ধতি।

🎗Hormone Therapy: হরমোন-নির্ভর ক্যান্সারের চিকিৎসা

এই থেরাপি সেই ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য কার্যকর যা হরমোনের (যেমন - ইস্ট্রোজেন অথবা প্রোজেস্টেরন) উপর নির্ভর করে বৃদ্ধি পায় (হরমোন রিসেপ্টর পজিটিভ ক্যান্সার)। হরমোন থেরাপি হরমোনের প্রভাব বন্ধ করে বা কমিয়ে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে।

  • বিবরণঃ সাধারণত ৫-১০ বছর ধরে মুখে খাওয়ার ঔষধ হিসেবে দেওয়া হয়।
  • কার জন্যঃ ER-পজিটিভ অথবা PR-পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীদের জন্য।
  • ঔষধের প্রকারভেদঃ
    • Tamoxifen: ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টরকে ব্লক করে কাজ করে এবং Pre-MenopausalPost-Menopausal উভয় নারীর জন্যই ব্যবহৃত হয়।
    • Aromatase Inhibitors - AIs: (যেমন - Anastrozole, Letrozole, এবং Exemestane) এই ঔষধগুলো শরীরের ইস্ট্রোজেন উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এটি সাধারণত Post-Menopause নারীদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
    • Ovarian Ablation/Suppression: Pre-Menopause নারীদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় থেকে ইস্ট্রোজেন উৎপাদন বন্ধ করা বা কমানো।


🎗Targeted Therapy: সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য

টার্গেটেড থেরাপি হলো এমন ঔষধ যা ক্যান্সার কোষের নির্দিষ্ট দুর্বলতা বা অণুগুলিকে লক্ষ্য করে কাজ করে, যা সাধারণ কোষের ক্ষতি কমিয়ে দেয়।

  • বিবরণঃ এই থেরাপিগুলো সাধারণত ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে টিউমারের নির্দিষ্ট বায়োমার্কার (যেমন HER2 প্রোটিন) শনাক্ত করার পর দেওয়া হয়।
  • কার জন্যঃ HER2-পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং কিছু অন্যান্য নির্দিষ্ট প্রকারের জন্য।
  • উদাহরণঃ
    • HER2-টার্গেটেড ঔষধঃ Trastuzumab, Pertuzumab, এবং Lapatinib।
    • CDK4/6 Inhibitors: (যেমনঃ Palbociclib, Ribociclib, এবং Abemaciclib) হরমোন রিসেপ্টর-পজিটিভ, HER2-নেগেটিভ উন্নত ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য।
    • PARP Inhibitors: (যেমন Olaparib) BRCA জিনের মিউটেশনযুক্ত ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য।


🎗Immunotherapy: শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ

ইমিউনোথেরাপি হলো এমন চিকিৎসা যা শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।

  • বিবরণঃ এই থেরাপিগুলো ক্যান্সার কোষের "ছদ্মবেশ" উন্মোচন করে, যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাদের চিনতে ও আক্রমণ করতে পারে।
  • কার জন্যঃ বর্তমানে, এটি প্রাথমিকভাবে ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের (TNBC) কিছু উন্নত ক্ষেত্রে বা নির্দিষ্ট বায়োমার্কার (যেমন PD-L1) পজিটিভ হলে ব্যবহৃত হয়।
  • উদাহরণঃ Pembrolizumab।


🎗পুনর্গঠনমূলক সার্জারিঃ জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণ

Mastectomy - এর পর স্তনের আকৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য পুনর্গঠনমূলক সার্জারি করা যেতে পারে। এটি রোগীর আত্মবিশ্বাস এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

  • বিবরণঃ এটি সাধারণত মাস্টেক্টমির পরপরই বা পরবর্তীতে আলাদাভাবে করা যেতে পারে।
  • প্রকারভেদঃ
    • ইমপ্ল্যান্ট-ভিত্তিক পুনর্গঠন (Implant-Based Reconstruction): সিলিকন বা স্যালাইন ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করে স্তন তৈরি করা।
    • টিস্যু ফ্ল্যাপ পুনর্গঠন (Tissue Flap Reconstruction): রোগীর শরীরের অন্য অংশ থেকে (যেমন - পেট, পিঠ বা উরু) টিস্যু নিয়ে নতুন স্তন তৈরি করা।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা একটি জটিল এবং ব্যক্তিগতকৃত প্রক্রিয়া। প্রতিটি রোগীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার পরিকল্পনা তার রোগ, তার নিজস্ব শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসকের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। দ্রুত নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা সাফল্যের হারকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে।


৮. স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধব্যবস্থাপনা


ব্রেস্ট ক্যান্সার (Breast Cancer) প্রতিরোধ এবং এর সফল ব্যবস্থাপনার জন্য জীবনযাত্রার পরিবর্তন, নিয়মিত স্ক্রিনিং এবং ঝুঁকি কমানোর কৌশল অবলম্বন করা অপরিহার্য।


🎗স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন

জীবনযাত্রার সঠিক অভ্যাস গড়ে তোলা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।


  • নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপঃ

    • নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ কেবল সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতেই নয়, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতেও এবং এর চিকিৎসাপরবর্তী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক কৌশল যা বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে।

  • শারীরিক কার্যকলাপ কীভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়?

    • নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর নিম্নলিখিত উপায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেঃ
      • হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখাঃ অতিরিক্ত ওজন শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, যা হরমোন-রিসেপ্টর পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রধান চালিকাশক্তি। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করে, ফলে ইস্ট্রোজেন এবং ইনসুলিনের মতো হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, পোস্টমেনোপজাল মহিলাদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের উচ্চ মাত্রা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। (সূত্রঃ American Cancer Society, World Health Organization)
      • ওজন নিয়ন্ত্রণঃ স্থূলতা ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি প্রমাণিত ঝুঁকি ফ্যাক্টর, বিশেষ করে মেনোপজের পরে। শারীরিক কার্যকলাপ ক্যালরি খরচ বাড়িয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে বা অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। সুস্থ ওজন বজায় রাখা ইস্ট্রোজেন এবং ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করে। (সূত্রঃ National Cancer Institute, Breastcancer.org)
      • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে, যা ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করতে এবং ধ্বংস করতে আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে। একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম ক্যান্সারের প্রাথমিক কোষগুলোকে দমন করতে সহায়ক। (সূত্রঃ Journal of Applied Physiology)
      • প্রদাহ হ্রাসঃ দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বিভিন্ন ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে যুক্ত। শারীরিক কার্যকলাপ শরীরের প্রদাহের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। (সূত্রঃ Cancer Research UK)
      • ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স উন্নত করাঃ ব্যায়াম ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়, যা রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। উচ্চ ইনসুলিনের মাত্রা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারে, বিশেষত কিছু ধরণের ব্রেস্ট ক্যান্সারে। (সূত্রঃ American Institute for Cancer Research)

  • কতটা শারীরিক কার্যকলাপ প্রয়োজন?
    • আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার শারীরিক কার্যকলাপের সুপারিশ করেঃ
      • প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যঃ
        • মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক (Aerobic) কার্যকলাপঃ সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট (যেমনঃ দ্রুত হাঁটা, হালকা জগিং, সাইক্লিং)।

        • উচ্চ-তীব্রতার অ্যারোবিক কার্যকলাপঃ সপ্তাহে অন্তত ৭৫ মিনিট (যেমনঃ দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, তীব্র সাইক্লিং)।

        • পেশী শক্তিশালীকরণ কার্যকলাপঃ সপ্তাহে অন্তত ২ দিন শরীরের সমস্ত প্রধান পেশী গোষ্ঠীর জন্য ব্যায়াম (যেমনঃ ওয়েট লিফটিং, পুশ-আপস, সিট-আপস)। (সূত্রঃ WHO Global Recommendations on Physical Activity for Health, ACS Guidelines for Nutrition and Physical Activity for Cancer Prevention)
      • ক্যান্সার থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের জন্যঃ ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণকারী বা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে উঠা ব্যক্তিদের জন্য শারীরিক কার্যকলাপ অত্যন্ত উপকারী। এটি ক্লান্তি, উদ্বেগ, হতাশা কমাতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে। তবে, কোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা লিম্ফেডেমার মতো অবস্থার ক্ষেত্রে।

  • দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক কার্যকলাপ যুক্ত করার কৌশলঃ

    • ছোট থেকে শুরু করুনঃ শুরুতেই কঠিন ব্যায়াম না করে, প্রতিদিন অল্প সময় ধরে হাঁটা বা হালকা স্ট্রেচিং দিয়ে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে সময় ও তীব্রতা বাড়ান।
    • পছন্দের কার্যকলাপ বেছে নিনঃ যে ব্যায়াম বা কার্যকলাপগুলো আপনি উপভোগ করেন, সেগুলোকে বেছে নিন। এতে করে ব্যায়াম নিয়মিত করার অনুপ্রেরণা পাবেন। যেমনঃ নাচ, বাগান করা, সাঁতার কাটা, যোগব্যায়াম, বা দলগত খেলা।
    • দৈনন্দিন রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুনঃ লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, কাছাকাছি গন্তব্যে হেঁটে যান, অথবা কাজের ফাঁকে ছোট বিরতি নিয়ে কিছু স্ট্রেচিং বা হাঁটাচলা করুন।
    • সহায়তা নিনঃ একজন ফিটনেস প্রশিক্ষক বা থেরাপিস্টের সাথে কাজ করতে পারেন, যিনি আপনার জন্য নিরাপদ এবং কার্যকর একটি ব্যায়াম পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করবেন, বিশেষ করে যদি আপনার কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকে।

নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে তোলা ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আপনার লড়াইয়ে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করবে এবং সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে।


  • সুস্থ ওজন বজায় রাখাঃ

    • একটি সুস্থ ওজন বজায় রাখা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর এবং রোগটির চিকিৎসাপরবর্তী ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থূলতা (Obesity) বা অতিরিক্ত ওজন, বিশেষ করে মেনোপজের পরে, ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি প্রমাণিত ঝুঁকি উপাদান হিসেবে বিবেচিত।

  • তিরিক্ত ওজন কীভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়?
    • অতিরিক্ত চর্বি বা মেদ শরীরে বিভিন্ন জৈবিক পরিবর্তনের জন্ম দেয়, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারেঃ

      • ১. হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ

        • ইস্ট্রোজেন উৎপাদন বৃদ্ধিঃ মেনোপজের পর ডিম্বাশয় ইস্ট্রোজেন উৎপাদন বন্ধ করে দিলেও, শরীরের চর্বি কোষগুলো ইস্ট্রোজেন তৈরি করতে থাকে। অতিরিক্ত ওজন মানে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি কোষ, যা ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই উচ্চ ইস্ট্রোজেন হরমোন-রিসেপ্টর পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে। (সূত্রঃ American Cancer Society, World Cancer Research Fund)
        • ইনসুলিন ও ইনসুলিন-লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর-১ (IGF-1) বৃদ্ধিঃ অতিরিক্ত ওজন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে, যার ফলে রক্তে ইনসুলিন এবং IGF-1 এর মাত্রা বেড়ে যায়। এই দুটি হরমোন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ও বিভাজনকে উৎসাহিত করতে পারে। (সূত্রঃ American Institute for Cancer Research)

      • ২. দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহঃ অতিরিক্ত চর্বি কোষগুলো প্রদাহজনক রাসায়নিক পদার্থ (Pro-Inflammatory Cytokines) উৎপন্ন করে, যা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ডিএনএ-এর ক্ষতি করতে পারে এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারে। (সূত্রঃ National Cancer Institute)

      • ৩. ফ্যাট কোষের ভূমিকাঃ চর্বি কোষগুলো শুধুমাত্র ইস্ট্রোজেন উৎপাদন করে না, অন্যান্য প্রোটিন এবং অ্যাডিপোকাইনস (Adipokines) নামক হরমোনও তৈরি করে, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং মেটাস্ট্যাসিস (ছড়িয়ে পড়া) কে প্রভাবিত করতে পারে। (সূত্রঃ Breastcancer.org)

  • সুস্থ ওজন কীভাবে বজায় রাখবেন?

    • সুস্থ ওজন বলতে বোঝায় আপনার উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ওজন, যা বডি মাস ইনডেক্স (BMI) দ্বারা পরিমাপ করা হয়। BMI ১৯ থেকে ২৪.৯ এর মধ্যে থাকা সাধারণত সুস্থ ওজন নির্দেশ করে।
      • ১. ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণঃ

        • আর্টিকেলটির পরবর্তী অংশে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তবে সংক্ষেপে, প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি, এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বি পরিহার করে ফলমূল, শাকসবজি, গোটা শস্য এবং চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা ওজন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত সহায়ক।

      • ২. নিয়মিত শরীরকে সক্রিয় রাখাঃ

        • আর্টিকেলের পূর্ববর্তী অংশে আলোচনা করা হয়েছে যে, নিয়মিত ব্যায়াম ক্যালরি খরচ বাড়িয়ে এবং মেটাবলিজম উন্নত করে ওজন কমাতে ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৬০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার ব্যায়াম করা উচিত।

      • ৩. পরিমিত খাদ্যাভ্যাসঃ

        • আপনি কী খাচ্ছেন, তার পাশাপাশি কতটা খাচ্ছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। খাবারের পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনের বেশি খাওয়া এড়িয়ে চলুন।

      • ৪. পর্যাপ্ত ঘুমঃ

        • অপর্যাপ্ত ঘুম হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ঘটাতে পারে, যা ক্ষুধা এবং ওজন বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

      • ৫. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণঃ

        • মানসিক চাপ কিছু মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত খাওয়া এবং ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা অন্যান্য শিথিলকরণ কৌশল মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

      • ৬. ধারাবাহিকতা ও ধৈর্য্যঃ

        • ওজন কমানো বা সুস্থ ওজন বজায় রাখা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এতে ধারাবাহিকতা এবং ধৈর্য প্রয়োজন। ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন এবং সেগুলোকে অর্জনের চেষ্টা করুন।
সুস্থ ওজন বজায় রাখা শুধু ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিই কমায় না, বরং ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং অন্যান্য অনেক দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে। এটি আপনার সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং দীর্ঘ, সুস্থ জীবন লাভে সহায়তা করে।

  • সুষম খাদ্য গ্রহণঃ

    • একটি সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে এবং এর চিকিৎসাপরবর্তী সুস্থ জীবনযাত্রায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু ওজন নিয়ন্ত্রণেই নয়, শরীরের কোষগুলোকে সুরক্ষা দিতে এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী প্রদাহ কমাতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করার সুপারিশ করেন।

  • সুষম খাদ্য কীভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়?

    • সঠিক খাদ্যাভ্যাস বিভিন্ন উপায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করেঃ

      • ১. Antioxidants এর সরবরাহঃ ফলমূল এবং শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে (যেমনঃ ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, বিটা-ক্যারোটিন, সেলেনিয়াম)। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো শরীরের কোষগুলোকে ফ্রি র‍্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, যা ডিএনএ-এর ক্ষতি করতে পারে এবং ক্যান্সার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। (সূত্রঃ American Institute for Cancer Research - AICR)

      • ২. প্রদাহ হ্রাসঃ কিছু খাদ্য উপাদান, যেমন - ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং কিছু ফাইটোকেমিক্যাল, শরীরে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তারকে উৎসাহিত করতে পারে। (সূত্রঃ World Cancer Research Fund - WCRF)

      • ৩. হরমোন নিয়ন্ত্রণঃ কিছু খাদ্য (যেমন - ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার) শরীরে ইস্ট্রোজেনের মতো হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। বিশেষ করে মেনোপজের পর অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফাইবার হজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। (সূত্রঃ National Cancer Institute)

      • ৪. সুস্থ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাঃ একটি সুষম খাদ্য অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ রোধ করে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে। যেমনটা আমরা আগেই আলোচনা করেছি, অতিরিক্ত ওজন ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

      • ৫. রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণঃ সুষম খাদ্য রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, যা ইনসুলিনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখে। উচ্চ ইনসুলিন মাত্রা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে।

  • ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক খাদ্য উপাদান ও কৌশলঃ
    • একটি ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর খাবার তালিকায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিতঃ

      • ১. প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজিঃ

        • প্রতিদিন বিভিন্ন রঙের ফলমূল এবং শাকসবজি (কমপক্ষে ৫-৯ পরিবেশন) খাদ্যতালিকায় রাখুন। গাঢ় সবুজ শাকসবজি (পালং শাক, ব্রোকলি), ক্রুসিফেরাস সবজি (ফুলকপি, বাঁধাকপি), বেরি ফল, সাইট্রাস ফল (কমলা, লেবু) বিশেষভাবে উপকারী।

        • এগুলোতে ফাইবার, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং ফাইটোকেমিক্যালস (উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক) থাকে যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

      • ২. গোটা শস্যঃ

        • সাদা রুটি, সাদা চালের পরিবর্তে বাদামী চাল, ওটস, কুইনোয়া, আস্ত গম এবং অন্যান্য গোটা শস্য বেছে নিন। এগুলো ফাইবারে ভরপুর এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। (সূত্রঃ American Institute for Cancer Research - AICR)

      • ৩. চর্বিহীন প্রোটিনঃ
        • লাল মাংস (গরু, ছাগল) সীমিত করে মাছ (বিশেষ করে তৈলাক্ত মাছ যেমন স্যালমন, ম্যাকেরেল - ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের জন্য), মুরগির মাংস (চামড়া ছাড়া), মটরশুঁটি, ডাল, টোফু এবং বাদাম জাতীয় চর্বিহীন প্রোটিন বেছে নিন।

      • ৪. স্বাস্থ্যকর চর্বিঃ

        • ট্রান্স ফ্যাট এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমনঃ প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত লাল মাংস) পরিহার করুন।

        • এর পরিবর্তে অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ এবং তৈলাক্ত মাছে পাওয়া স্বাস্থ্যকর অসম্পৃক্ত চর্বি গ্রহণ করুন।

      • ৫. সীমিত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবারঃ

        • মিষ্টি পানীয়, প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাকস, ফাস্ট ফুড এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ এগুলো ওজন বৃদ্ধি এবং প্রদাহ সৃষ্টিতে অবদান রাখে।

      • ৬. অ্যালকোহল বা মদ সেবন পরিহার করুনঃ

        • অ্যালকোহল গ্রহণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অ্যালকোহল সেবন ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ঝুঁকি কমাতে অ্যালকোহল পরিহার করা উচিত। (সূত্রঃ Centers for Disease Control and Prevention - CDC)

      • ৭. Caffeine and Antioxidants:

        • কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কফি ও চায়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে, তবে এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা যেতে পারে। (সূত্রঃ National Institutes of Health - NIH)
      • ৮. ধূমপান ত্যাগঃ
        • ধূমপান ক্যান্সারের সামগ্রিক ঝুঁকি বাড়ায়, যার মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারও অন্তর্ভুক্ত। ধূমপান ত্যাগ করা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

      • ৯. বিশেষ কিছু খাদ্য উপাদানঃ

        • হলুদঃ হলুদে থাকা কারকিউমিন (Curcumin) একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক হতে পারে।

        • কালোজিরাঃ কালোজিরা তার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য সুপরিচিত। এটি সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারার একটি সহায়ক অংশ হতে পারে।

          আপনার সুস্থ জীবনযাত্রায় কালোজিরা কীভাবে যোগ করতে পারেন, তা বিস্তারিত জানতে আমাদের এই বিশেষ লেখাটি কালোজিরা লিখাতে ক্লিক করে দেখুন।

        • সবুজ চাঃ সবুজ চায়ে থাকা পলিফেনল (Polyphenols) ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধে ভূমিকা রাখে।

        • ছোলা, মসুর ডালঃ এগুলোতে থাকা ফাইবার এবং ফাইটোকেমিক্যালস হরমোন-সংশ্লিষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।
  • সুষম খাদ্যের কৌশলঃ
    • পরিমিত খাদ্যাভ্যাসঃ আপনি কী খাচ্ছেন তার পাশাপাশি কতটা খাচ্ছেন তা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

    • নিয়মিত খাবার গ্রহণঃ দিনে তিন থেকে চারটি ছোট বা মাঝারি আকারের খাবার গ্রহণ করুন, যাতে রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল থাকে।

    • হাইড্রেটেড থাকাঃ পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।

    • রান্নার পদ্ধতিঃ স্বাস্থ্যকর রান্নার পদ্ধতি (যেমনঃ স্টিমিং, বেকিং, গ্রিলিং) বেছে নিন এবং অতিরিক্ত তেল বা চর্বি ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।

একটি সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ আপনার শরীরকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তোলে, যা কেবল ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিই কমায় না, বরং সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থ জীবন লাভে সহায়তা করে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিজ্ঞা, যা আপনার সুস্থ জীবনের ভিত্তি স্থাপন করবে।


🎗নিয়মিত স্ক্রিনিং ও সচেতনতা

প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করতে স্ক্রিনিং পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • স্তন স্ব বা নিজে পরীক্ষাঃ
    • ২০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে একবার নিজের স্তন পরীক্ষা করা উচিত। এটি আপনার স্তনের স্বাভাবিক গঠন সম্পর্কে ধারণা দেয়, যা যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দ্রুত ধরতে সাহায্য করতে পারে।
    • মাসিক/ পিরিয়ড চক্রের পর (মাসিক শুরু হওয়ার ৭-১০ দিন পর) এই পরীক্ষা করা সবচেয়ে উপযুক্ত সময়, কারণ এই সময় স্তন কম সংবেদনশীল থাকে।

  • বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসক দ্বারা স্তন পরীক্ষাঃ

    • একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা নিয়মিত শারীরিক স্তন পরীক্ষা করানো উচিত।
    • ২০-৪০ বছর বয়সী নারীদের জন্য প্রতি ১-৩ বছর অন্তর এবং ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের প্রতি বছর একবার CBE করানো সুপারিশ করা হয়।

  • Mammogram:

    • ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্ক্রিনিংয়ের জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের জন্য নিয়মিত ম্যামোগ্রাম স্ক্রিনিং সুপারিশ করা হয় (সাধারণত প্রতি বছর বা দুই বছর অন্তর)।
    • উচ্চ ঝুঁকির (যেমন পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক মিউটেশন) ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কম বয়সেও ম্যামোগ্রাম বা এমআরআই স্ক্রিনিং শুরু করা যেতে পারে।

  • জিনগত পরীক্ষা ও পরামর্শঃ

    • যদি আপনার পরিবারে স্তন ক্যান্সার বা জরায়ু/ ওভারিয়ান ক্যান্সারের শক্তিশালী ইতিহাস থাকে, বিশেষ করে অল্প বয়সে, তবে জেনেটিক কাউন্সেলিং করানো উচিত।
    • BRCA1, BRCA2 সহ অন্যান্য সম্পর্কিত জিনের মিউটেশনের জন্য জেনেটিক টেস্টিং করানো যেতে পারে, যা আপনার ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেবে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।


🎗ঝুঁকি কমানোর কৌশল

উচ্চ ঝুঁকির ব্যক্তিদের জন্য কিছু অতিরিক্ত প্রতিরোধমূলক কৌশল বিবেচনা করা যেতে পারে।

  • ঝুঁকি-হ্রাসকারী ঔষধঃ

    • নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ (যেমন - Tamoxifen বা Raloxifene) ব্রেস্ট ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা নারীদের ক্ষেত্রে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে পারে। এই ঔষধগুলো হরমোন রিসেপ্টর-পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
    • তবে এই ঔষধগুলোর সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সুবিধা নিয়ে চিকিৎসকের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরি।

  • প্রতিরোধমূলক সার্জারিঃ

    • BRCA1 বা BRCA2 জিনের মিউটেশন যাদের আছে, তাদের জন্য প্রতিরোধমূলক মাস্টেক্টমি (Prophylactic Mastectomy) বা উভয় স্তন অপসারণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
    • প্রতিরোধমূলক ডিম্বাশয় অপসারণ (Prophylactic Oophorectomy) ওভারিয়ান বা জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়, বিশেষ করে হরমোন-সংবেদনশীল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে।
    • এই ধরনের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিত।

  • স্তন্যপান করানোঃ

    • যদি সম্ভব হয়, শিশুদের দীর্ঘ সময় ধরে স্তন্যপান করানো উচিৎ। গবেষণায় দেখা গেছে, স্তন্যপান করানো ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।


🎗দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাপনা

ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয় এবং চিকিৎসার পরেও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ।

  • পরবর্তী পরিচর্যাঃ

    • চিকিৎসার পর নিয়মিত ফলো-আপ চেক-আপ বা পরবর্তী পরিচর্যা, ইমেজিং পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এটি ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তি বা নতুন ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ থাকলে দ্রুত শনাক্ত করতে সাহায্য করে।

  • স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা বজায় রাখাঃ

    • ক্যান্সার পরবর্তী সময়েও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন চালিয়ে যাওয়া রোগের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমাতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।

  • মানসিক ও সামাজিক সহায়তাঃ

    • ব্রেস্ট ক্যান্সার একটি আবেগগতভাবে চ্যালেঞ্জিং রোগ। সহায়তা গোষ্ঠী, কাউন্সেলিং বা থেরাপি মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে। পরিবারের সমর্থনও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং ব্যবস্থাপনার এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে আমরা এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও শক্তিশালী হতে পারি। সচেতনতা বাড়িয়ে এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলে আমরা একটি সুস্থ সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারি।


৯. ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও রোগের পূর্বাভাস


ব্রেস্ট ক্যান্সারের পূর্বাভাস বা প্রগনোসিস একাধিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলোঃ

ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে সুস্থ নারী গোলাপী ফিতা ধরে হাসছেন।
ব্রেস্ট ক্যান্সার মুক্ত জীবনঃ সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতায় সুস্থতার হাসি।

🎗চিকিৎসার পর জীবনকাল ও সুস্থতার হার

ব্রেস্ট ক্যান্সারের ভবিষ্যৎ ফলাফল (Prognosis) বুঝতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রোগীর বেঁচে থাকার হার। সাধারণত এটি ৫ বছর পর্যন্ত রোগী বেঁচে থাকেন কি না, তা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ, রোগ শনাক্ত হওয়ার ৫ বছর পর কতজন রোগী এখনও জীবিত — সেটিই ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার নামে পরিচিত।

  • রোগের পর্যায়ঃ

    • প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয়ঃ ব্রেস্ট ক্যান্সারের পূর্বাভাস সবচেয়ে ভালো হয় যখন রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে (স্টেজ ০ বা স্টেজ ১) ধরা পড়ে, অর্থাৎ ক্যান্সার স্থানীয়ভাবে স্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং লিম্ফ নোড বা শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়েনি। এই পর্যায়ে ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার ৯০% এর বেশি হতে পারে। বাংলাদেশেও প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়া রোগীর সুস্থতার হার অনেক বেশি।

    • স্থানীয়ভাবে উন্নত পর্যায়ঃ যদি ক্যান্সার স্থানীয় লিম্ফ নোডে (স্টেজ ২ বা স্টেজ ৩) ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সুস্থতার হার কিছুটা কমে আসে, তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি ৭০-৮০% পর্যন্ত হতে পারে।

    • Metastatic Stage - Stage IV: যদি ব্রেস্ট ক্যান্সার শরীরের দূরবর্তী অঙ্গে (যেমনঃ ফুসফুস, যকৃত, হাড়, মস্তিষ্ক) ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এটিকে মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার বলে। এই পর্যায়ে নিরাময় সম্ভব না হলেও, আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর জীবনকাল বাড়ানো এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব হয়। এই পর্যায়ে ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার তুলনামূলকভাবে কম (৩০-৪০%)।

  • Type of Cancer & Biomarkers:

    • Hormone Receptor Status - ER/PR Positive: ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর-পজিটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারগুলো সাধারণত হরমোন থেরাপিতে ভালোভাবে সাড়া দেয় এবং অন্যান্য প্রকারের তুলনায় তুলনামূলকভাবে ভালো প্রগনোসিস থাকে।

    • HER2 Status - HER2 Positive/Negative: HER2-পজিটিভ ক্যান্সারগুলো ঐতিহাসিকভাবে আক্রমণাত্মক হলেও, এখন HER2-টার্গেটেড থেরাপি (যেমন - ট্রাস্টুজুমাব) ব্যবহার করে এদের জন্য একটি ভালো প্রগনোসিস নিশ্চিত করা যায়। HER2-নেগেটিভ ক্যান্সারগুলো সাধারণত ভালো প্রগনোসিস বহন করে, যদি না সেগুলো ট্রিপল নেগেটিভ হয়।

    • Triple-Negative Breast Cancer - TNBC: TNBC সাধারণত আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এর কোনো সুনির্দিষ্ট হরমোন বা HER2 টার্গেট না থাকায় চিকিৎসার বিকল্প কম থাকে। তবে, সাম্প্রতিক ইমিউনোথেরাপি এবং কেমোথেরাপির অগ্রগতির কারণে TNBC এর প্রগনোসিসও কিছুটা উন্নত হয়েছে।

    • Tumour Grade: টিউমার গ্রেড নির্দেশ করে ক্যান্সার কোষগুলো স্বাভাবিক কোষের থেকে কতটা ভিন্ন এবং কত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম গ্রেডের (Grade 1) ক্যান্সার কোষগুলো স্বাভাবিক কোষের মতো দেখতে এবং ধীরে বৃদ্ধি পায়, তাই এদের Prognosis বা আরোগ্য সম্ভাবনা ভালো। উচ্চ গ্রেডের (Grade 3) ক্যান্সার কোষগুলো অস্বাভাবিক এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তাই Prognosis বা আরোগ্য সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়।

  • রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও বয়সঃ

    • বয়সঃ তুলনামূলকভাবে কম বয়সী রোগীদের (বিশেষ করে ৪০ এর নিচে) মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রায়শই বেশি আক্রমণাত্মক হয়। তবে সামগ্রিকভাবে, তরুণ রোগীদের সুস্থতার হার তাদের বার্ধক্যের তুলনায় ভালো হতে পারে, কারণ তারা চিকিৎসা ভালোভাবে সহ্য করতে পারে।

    • অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাঃ রোগীর যদি ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে চিকিৎসার জটিলতা বাড়তে পারে এবং Prognosis কিছুটা প্রভাবিত হতে পারে।

  • চিকিৎসার প্রতি সাড়াঃ

    • চিকিৎসা (সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন, হরমোন থেরাপি ইত্যাদি) শুরুর পর ক্যান্সার কোষগুলো কত ভালোভাবে সাড়া দিচ্ছে, তার উপরও Prognosis নির্ভর করে। যদি ক্যান্সার চিকিৎসা ভালোভাবে সাড়া দেয় এবং টিউমার ছোট হয়ে যায়, তাহলে Prognosis ভালো হয়।

  • রোগের পুনরাবৃত্তিঃ

    • যদি ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসার পর ফিরে আসে (পুনরাবৃত্তি), তাহলে তা প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের চেয়ে ভিন্নভাবে আচরণ করতে পারে এবং এর প্রগনোসিসও পরিবর্তিত হতে পারে। স্থানীয় পুনরাবৃত্তি (Local Recurrence) হলে Prognosis Metastatic পুনরাবৃত্তির চেয়ে ভালো হয়।


🎗আধুনিক চিকিৎসার অগ্রগতি ও আশার আলো

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। নতুন নতুন টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, উন্নত সার্জিক্যাল কৌশল এবং রেডিয়েশন পদ্ধতি সুস্থতার হার বাড়াতে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করেছে।

  • ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসাঃ এখন ক্যান্সারের বায়োমার্কার পরীক্ষা করে প্রতিটি রোগীর জন্য সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব, যা প্রগনোসিস উন্নত করে।
  • প্রাথমিক স্ক্রিনিং প্রোগ্রামঃ উন্নত দেশগুলিতে ব্যাপক স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (যেমন - ম্যামোগ্রাম) থাকার কারণে রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, যা সুস্থতার হারকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশেও এই ধরনের সচেতনতা এবং স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম বাড়ানো সম্ভব হলে বহু জীবন রক্ষা করা যাবে।
  • ফলো-আপ কেয়ার (Follow-up Care): চিকিৎসার পর নিয়মিত ফলো-আপ কেয়ার এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন রোগের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে সহায়ক, যা দীর্ঘমেয়াদী প্রগনোসিসকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয় করা একটি কঠিন অভিজ্ঞতা হতে পারে, তবে আধুনিক চিকিৎসা এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে অনেকেই এই রোগ থেকে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা।


১০. স্তন ক্যান্সার নিয়ে জীবনযাপন


ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে জীবনযাপন বলতে শুধু চিকিৎসা গ্রহণ করা বোঝায় না, বরং রোগ নির্ণয়ের পর এবং চিকিৎসার সময় ও তার পরেও জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা, মানসিক শক্তি ধরে রাখা এবং প্রয়োজনে সহায়তা চাওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত।


🎗মানসিক ও শারীরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীদের শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।

  • শারীরিক পরিবর্তন ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ

    • ক্লান্তিঃ ক্যান্সার চিকিৎসা, বিশেষ করে কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপি, মারাত্মক ক্লান্তি সৃষ্টি করতে পারে যা মাস বা এমনকি বছর ধরে স্থায়ী হতে পারে। নিয়মিত বিশ্রাম, হালকা ব্যায়াম এবং সুষম খাদ্য এই ক্লান্তি মোকাবিলায় সাহায্য করে।

    • ব্যথাঃ সার্জারি, রেডিয়েশন বা ক্যান্সারের বিস্তারের কারণে ব্যথা হতে পারে। ব্যথানাশক ঔষধ, ফিজিওথেরাপি এবং অন্যান্য সহায়ক চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

    • লিম্ফেডেমা (Lymphedema): বগলের লিম্ফ নোড অপসারণের (অ্যাক্সিলারি লিম্ফ নোড ডিসেকশন) ফলে হাত বা বাহুতে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। লিম্ফেডেমা থেরাপি, কম্প্রেশন গার্মেন্টস এবং নির্দিষ্ট ব্যায়ামের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

    • চুল পড়া, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা হ্রাসঃ কেমোথেরাপির সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এগুলোর জন্য সহায়ক ঔষধ এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন (যেমন ছোট ছোট খাবার গ্রহণ) কার্যকর হতে পারে।

    • ত্বকের পরিবর্তনঃ রেডিয়েশন থেরাপির ফলে ত্বকে লালচে ভাব, শুষ্কতা বা জ্বালাপোড়া হতে পারে। ময়েশ্চারাইজার এবং বিশেষ যত্নের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

  • মানসিক ও আবেগিক প্রভাবঃ

    • ভয় ও উদ্বেগঃ রোগের পুনরাবৃত্তি বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তা খুবই স্বাভাবিক।

    • হতাশা ও বিষণ্নতাঃ শারীরিক পরিবর্তন, চিকিৎসার ধকল এবং জীবনধারার পরিবর্তনের কারণে হতাশা বা বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে।

    • শারীরিক চিত্রের পরিবর্তনঃ স্তন অপসারণ (মাস্টেক্টমি) বা অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তন একজন নারীর আত্মবিশ্বাস এবং শারীরিক চিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পুনর্গঠনমূলক সার্জারি, কৃত্রিম স্তন (Prosthesis) ব্যবহার এবং কাউন্সেলিং এক্ষেত্রে সহায়ক।

    • সম্পর্কের উপর প্রভাবঃ অংশীদার, পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের উপর ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রভাব পড়তে পারে। খোলাখুলি আলোচনা এবং একে অপরের প্রতি সমর্থন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।


🎗সহায়তা গোষ্ঠী ও কাউন্সেলিং

মানসিক ও আবেগিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পেশাদার সহায়তা এবং সমমনাদের সাথে যোগাযোগ অত্যন্ত কার্যকর।

  • সহায়তা গোষ্ঠী (Support Groups):

    • অন্যান্য ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীদের সাথে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া মানসিক স্বস্তি দিতে পারে। তারা আপনার অনুভূতি বুঝতে পারে এবং ব্যবহারিক পরামর্শ দিতে পারে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন এনজিও এবং হাসপাতাল-ভিত্তিক সহায়তা গোষ্ঠী রয়েছে (যেমন - বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরাম)।
    • অনলাইন সহায়তা গোষ্ঠী এবং ফোরামও (যেমন - আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির অনলাইন কমিউনিটি) একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থান হতে পারে, বিশেষ করে যারা ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিতে পারেন না।

  • কাউন্সেলিং ও থেরাপিঃ

    • একজন পেশাদার মনোবিজ্ঞানী বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলা উদ্বেগ, হতাশা, ভয় এবং মানসিক চাপ মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে। তারা কার্যকর মোকাবিলা কৌশল (Coping Mechanisms) শেখাতে পারেন।
    • দম্পতিদের কাউন্সেলিং সম্পর্কের টানাপোড়েন মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।

  • মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের ভূমিকাঃ

    • ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সাইকো-অনকোলজিস্টরা ক্যান্সার রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।


🎗পুনর্বাসন ও সুস্থ জীবনযাপন

চিকিৎসার পর সুস্থ জীবনযাপনে ফিরে আসা এবং রোগের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করা পুনর্বাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

  • ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়ামঃ

    • সার্জারির পর হাত ও কাঁধের নড়াচড়া স্বাভাবিক করতে ফিজিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ। লিম্ফেডেমা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণেও নির্দিষ্ট ব্যায়াম সহায়তা করে।
    • নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ কেবল শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতেই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সাহায্য করে।

  • পুষ্টিঃ

    • চিকিৎসার সময় এবং পরে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ শক্তি বজায় রাখতে এবং শরীরকে সুস্থ হতে সাহায্য করে। একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
    • ক্যান্সার-প্রতিরোধী খাদ্য (যেমনঃ প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি এবং গোটা শস্য) রোগের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমাতেও সহায়তা করতে পারে।

  • Follow-up Care:

    • চিকিৎসার পর নিয়মিত ফলো-আপ ভিজিট এবং স্ক্রিনিং পরীক্ষা (যেমন - ম্যামোগ্রাম, রক্ত পরীক্ষা) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি রোগের পুনরাবৃত্তি বা নতুন ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ থাকলে দ্রুত শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
    • চিকিৎসক একটি নির্দিষ্ট ফলো-আপ সময়সূচী নির্ধারণ করে দেবেন যা কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত।

  • কর্মজীবনে ফিরে আসা ও সামাজিক জীবনঃ

    • অনেকে চিকিৎসার পর স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে আসতে চান। কর্মজীবনের পরিবর্তন বা কাজের সময়সূচীর সামঞ্জস্যের প্রয়োজন হতে পারে।
    • সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের সাথে বসবাস একটি ব্যক্তিগত যাত্রা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপেই সমর্থন এবং সঠিক তথ্যের প্রয়োজন হয়। রোগী, তার পরিবার এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সুস্থ ও মানসম্মত জীবনযাপনের পথ খুলে দেয়।


১১. উপসংহার


ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার (Breast Cancer) বর্তমান বিশ্বে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। এই রোগের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ আমাদের সবার জন্য একটি সতর্কবার্তা। তবে, এই মরণব্যাধি অদম্য নয়। সঠিক তথ্য, সচেতনতা, এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমেই আমরা এর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে পারি।

আমরা এই বিস্তারিত আলোচনায় ব্রেস্ট ক্যান্সার কী, এর কারণ, লক্ষণ, নির্ণয় পদ্ধতি, আধুনিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায়গুলো তুলে ধরেছি। মনে রাখবেন, নিয়মিত স্তন স্ব-পরীক্ষা, ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সাম এবং বয়স অনুযায়ী ম্যামোগ্রামের মতো স্ক্রিনিং পরীক্ষাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, তখন এর নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে এবং চিকিৎসার ফলাফলও উন্নত হয়।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। যদি আপনার পরিবারে এই রোগের ইতিহাস থাকে বা আপনি কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ অনুভব করেন, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না। আপনার শরীর আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। এটিকে গুরুত্ব দিন এবং এর যত্ন নিন। আসুন, আমরা সবাই মিলে ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন হই এবং আমাদের আশেপাশের মানুষকেও সচেতন করি, যাতে এই রোগ আর কোনো জীবন অকালে কেড়ে নিতে না পারে।


তথ্যসূত্র (References):

এই আর্টিকেলে প্রদত্ত সমস্ত তথ্য এবং উপাত্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর প্রকাশিত গবেষণা ও নির্দেশিকা থেকে সংগৃহীত। ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কিত আরও বিস্তারিত এবং হালনাগাদ তথ্যের জন্য নিম্নলিখিত উৎসগুলো অনুসরণ করতে পারেনঃ

👉বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization - WHO)
👉আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি (American Cancer Society - ACS)
👉ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (National Cancer Institute - NCI) - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
👉ম্যায়ো ক্লিনিক (Mayo Clinic)
👉সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (Centers for Disease Control and Prevention - CDC) - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
👉NHS (National Health Service) - যুক্তরাজ্য
👉মেডলাইনপ্লাস (MedlinePlus - National Library of Medicine - NIH)


১২. গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যচিকিৎসা সতর্কবার্তা


তথ্যের উদ্দেশ্য ও সীমাবদ্ধতাঃ

এই আর্টিকেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কিত যে বিস্তৃত তথ্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র সাধারণ জ্ঞান বৃদ্ধি এবং সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রকাশিত। এখানে উপস্থাপিত প্রতিটি তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস, গবেষণা এবং লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংকলিত, কিন্তু এগুলো কোনোভাবেই পেশাদার চিকিৎসা পরামর্শ, রোগ নির্ণয়, বা চিকিৎসার বিকল্প নয়।


দায়বদ্ধতার সীমাবদ্ধতাঃ

Opal's Lens (www.opalslens.com) বা এর লেখক এই আর্টিকেলে দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে পাঠক বা অন্য কারো দ্বারা গৃহীত কোনো স্ব-চিকিৎসা, ভুল রোগ নির্ণয়, অথবা কোনো চিকিৎসকের পরামর্শকে অগ্রাহ্য করার জন্য কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না


বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অপরিহার্যঃ

ব্রেস্ট ক্যান্সার একটি গুরুতর এবং জটিল রোগ, যার সঠিক চিকিৎসা কেবলমাত্র একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ (Oncologist) দ্বারা প্রদান করা সম্ভব। প্রতিটি রোগীর শারীরিক অবস্থা, রোগের পর্যায়, প্রকার, এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসার পরিকল্পনা ভিন্ন হতে পারে।

অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগঃ

আপনার বা আপনার পরিচিত কারো মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অথবা এই বিষয়ে কোনো উদ্বেগ থাকলে, কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে একজন নিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। শুধুমাত্র আপনার চিকিৎসকই আপনার সঠিক অবস্থা নির্ণয় করতে এবং আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার সুপারিশ করতে পারবেন।

বিশেষজ্ঞ মতামতকে প্রাধান্য দিনঃ

অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন, আপনার স্বাস্থ্য আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। কোনো অনলাইন তথ্যসূত্রের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল না হয়ে, সবসময় বিশেষজ্ঞের মতামতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিন।


১৩. FAQ: ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে প্রচলিত প্রশ্নোত্তর


এখানে ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলোঃ

প্রশ্নঃ পুরুষদের কি ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে?
  • উত্তরঃ হ্যাঁ, পুরুষদেরও ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে, তবে এটি খুবই বিরল। মোট ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রায় ১% পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। লক্ষণ, নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি নারীদের মতোই হতে পারে।
প্রশ্নঃ স্তনে পিণ্ড অনুভব করলেই কি তা ব্রেস্ট ক্যান্সার?
  • উত্তরঃ না, স্তনে পিণ্ড অনুভব করলেই সবসময় তা ব্রেস্ট ক্যান্সার নয়। বেশিরভাগ পিণ্ডই সৌম্য (Benign) বা অ-ক্যান্সারযুক্ত হয়ে থাকে, যেমন সিস্ট (তরলপূর্ণ থলি) বা Fibroadenoma (নিরীহ টিউমার)। তবে যেকোনো নতুন বা অস্বাভাবিক পিণ্ড অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
প্রশ্নঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার কি সংক্রামক রোগ?
  • উত্তরঃ না, ব্রেস্ট ক্যান্সার কোনো সংক্রামক রোগ নয়। এটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায় না। এটি জিনগত পরিবর্তন বা জীবনযাত্রার কারণে সৃষ্ট একটি রোগ।
প্রশ্নঃ নিয়মিত ম্যামোগ্রাম কি নিরাপদ? এর কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?
  • উত্তরঃ ম্যামোগ্রাম স্তনের একটি এক্স-রে পরীক্ষা। এতে খুব অল্প পরিমাণে বিকিরণ ব্যবহার করা হয়, যা সাধারণত নিরাপদ বলে বিবেচিত। ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয়ের জন্য ম্যামোগ্রাম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্ক্রিনিং পদ্ধতি এবং এর সুবিধা সম্ভাব্য ঝুঁকির চেয়ে অনেক বেশি।
প্রশ্নঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার কি সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য?
  • উত্তরঃ হ্যাঁ, ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা গেলে সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য। চিকিৎসার সাফল্যের হার রোগের পর্যায়, প্রকার এবং চিকিৎসার প্রতি শরীরের সাড়ার উপর নির্ভর করে। যত দ্রুত রোগ নির্ণয় হবে এবং চিকিৎসা শুরু হবে, সুস্থতার সম্ভাবনা তত বেশি।
প্রশ্নঃ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে ডায়েটের কোনো ভূমিকা আছে কি?
  • উত্তরঃ হ্যাঁ, স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি, গোটা শস্য এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত।
প্রশ্নঃ জিনগত কারণে ব্রেস্ট ক্যান্সার হলে কি প্রতিরোধ সম্ভব?
  • উত্তরঃ জিনগত কারণে (যেমন - BRCA মিউটেশন) ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকলে তা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা কঠিন হতে পারে। তবে নিয়মিত এবং নিবিড় স্ক্রিনিং (যেমন - ম্যামোগ্রাম, এমআরআই), ঝুঁকি কমানোর ঔষধ (Chemoprevention) বা কিছু ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক সার্জারি (Prophylactic Mastectomy) করে রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায় বা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে।
প্রশ্নঃ ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার পর কি আবার ক্যান্সার ফিরে আসতে পারে?
  • উত্তরঃ হ্যাঁ, ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার পর রোগের পুনরাবৃত্তি (Recurrence) হতে পারে। এটি স্থানীয়ভাবে (যেখানে ক্যান্সার হয়েছিল) বা দূরবর্তী অঙ্গে (Metastasis) ফিরে আসতে পারে। এজন্য চিকিৎসার পরও নিয়মিত ফলো-আপ চেক-আপ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অপরিহার্য।
প্রশ্নঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ের পর মানসিক চাপ মোকাবিলায় কী করা উচিত?
  • উত্তরঃ ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয় নিঃসন্দেহে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ মোকাবিলায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, পেশাদার কাউন্সেলিং, সহায়তা গোষ্ঠীতে যোগদান, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আলোচনা এবং মন শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন বা যোগব্যায়ামের মতো কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।

📌স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অংশ হিসেবে কালোজিরা কীভাবে আপনার দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে জানতে আমাদের পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধটি পড়তে পারেন। লিখাটি পড়তে কালোজিরার উপরে ক্লিক করুন।




Post a Comment

0 Comments